ইশরাত তানিয়া
সিলিং এর মাঝখানে ধীরে পাখা ঘুরছে। দিনের বেলাতেও বাতি জ্বলছে। জানলা দিয়ে দেখা যায় বাইরেটা ঘোলাটে। আকাশের গায়ে ম্যাড়ম্যাড়ে ঠাণ্ডা আলোর বিন্দু লেগে আছে। এমন আলোর কোনো স্বাদ গন্ধ তাপ থাকে না। ঘুম ভেঙে পুরুষটি দেখে সে জেগে আছে। চিত হয়ে শুধু পাখা আর বাতিটা দেখতে পায় সে। পিঠের নিচে সিমেন্টের মেঝের ঠাণ্ডা অনুভব। অবাক হয় পুরুষটি। এমন কি শতরঞ্চিও নেই। শীত শীত লাগে ওর। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আধহাতা জামার ভেতর। শোয়া থেকে সে উঠে দাঁড়ায়। পাখা আর বাতির সুইচ বন্ধ করে দেয়। আস্ত বিছানা রেখে সে কেন মেঝেতে শুয়ে ছিল ভাবতে ভাবতে প্রায় আধবোজা চোখে বালিশের তলা হাতড়ে সিগারেট খোঁজে।
সিগারেটের আগায় উজ্জ্বল লাল আগুনের আভা। চোখ থেকে ঘুম কাটলে মেয়েটিকে সে কোথাও দেখতে পায় না। মানে ওর স্ত্রী। হয়তো অফিসে চলে গেছে। অফিস ভাবতেই সময়ের হিসেব চলে এলো। বেলা দেখে বোঝার উপায় নেই ঘড়িতে তিনটা দশ। প্রায় সারাদিন ঘুমিয়ে কেটেছে ভাবতেই বিরক্ত বোধ করে পুরুষটি। সাইড টেবিলে মোবাইল ফোন রাখা। চার্জ নেই। অ্যাশট্রে নিয়ে সিগারেটের মুখে জমে থাকা ছাই ঝাড়ে সে। তারপর মোবাইল ফোন চার্জে দেয়। হয়তো অফিস যাবার সময় তাড়াহুড়োয় মেয়েটি বাতি বন্ধ করতে ভুলে গেছে, কিন্তু সে এমন কোনো সাজগোজ করে না যে দিনের বেলা আলগা আলোর প্রয়োজন হবে। একটা ট্যালকম পাউডার, চুলের ব্যান্ড কয়েকটা। এই তার সাজসরঞ্জাম। আর একটা লিপজেল। সারা বছর মেয়েটার ঠোঁট ফাটে। খসখসে ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। লিপজেল দেখেই কিনা শেষ কবে চুমু খেয়েছে মনে করার চেষ্টা করে সে। এই ভুলে যাওয়া তাকে বিষণ্ণ করে।
আলো আরেকটু কমে ঝাঁপিয়ে ফের বৃষ্টি আসে। এ বাড়িতে নিতান্ত পড়ালেখা বা সেলাইয়ের কাজ করতে হলে দিনে বাড়তি আলো লাগে। এখানে পড়ার কেউ নেই। লেখারও কেউ নেই। কেউ সেলাইও করে না। মেয়েটি অবশ্য একদিন পুরনো সেলাইয়ের বাক্স থেকে সুঁই বের করে কিছু একটা সেলাই করেছিল। জানলা দিয়ে বৃষ্টি ছিটকে ঘরে ঢোকে। সে উঠে জানলাটা লাগিয়ে দেয়। সারা বাড়ির জানলা হাট করে খোলা। সাদা পর্দাগুলো উড়ছে। বাড়ি বলতে দুটো ঘর। একটা শোবার আরেকটা বসার। রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া এক চিলতে খোলা জায়গায় খাবার টেবিল পাতা।
“কী যেন বদলে গেছে”- বিড়বিড় করতে করতে পুরুষটি পেশাব করে। গলা শুকিয়ে আসে ওর। সিগারেটের গোড়া অব্দি আগুন চলে এসেছে। সেটা বুজিয়ে খাওয়ার ঘরে যায় সে। টেবিলের ওপর পানির বোতল। পাশে আধপোড়া সিগারেটের পাহাড়। পানির বোতল তুলে নিয়ে আধবোতল পানি গিলে ফেলে। হাওয়ায় কেমন বাসি গন্ধ ভাসে। বাটিটা নাকের কাছে নিয়েই সবজি বিনে ফেলে দেয়। মেয়েটার হয়তো খুব তাড়াহুড়ো ছিল। নষ্ট হয়ে যাওয়া সবজি ফেলে দেবার সময় পায়নি। নরম রুটিগুলোও শুকিয়ে শক্ত। “কী জানি বদলে গেছে” – আবারও বিড়বিড় করে পুরুষটি। রান্না ঘরে চায়ের পানি বসায়। পানি সবে ফুটতে শুরু করেছে। ওর মনে পড়ে বসার ঘরের জানলা বন্ধ করা হয়নি।
মাথার নিচ থেকে কুশনটা পড়ে গেছে। বালিশ ছাড়াই গুটিসুটি হয়ে সোফায় শুয়ে আছে মেয়েটি। একটু আগেই ওর মনে হচ্ছিল সে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে। আকাশটা কাছাকাছি নেমে এসেছে। গাছ ঝিরঝিরিয়ে পাতা ঝরিয়ে দিচ্ছে চোখের ওপর। সোফায় শুয়ে থাকাটাও স্বপ্নের অংশই মনে হয়। চোখের ওপর পাতার বদলে এখন বৃষ্টির ফোঁটা। জেগে ওঠে মেয়েটি। জানলার কাচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা অবিরাম নেমে যায়। বাকিটা ছিটকে এসে পড়ে মেয়েটির গায়ে। এমন বৃষ্টির ছাঁট সেই কবে চোখেমুখে এসে লাগত। যেদিন স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়েও যাওয়া হয়নি। স্কুল ড্রেস পরে জানলার সামনে সে দাঁড়িয়ে। ঠাণ্ডার ধাত ছিল। বৃষ্টির পানি মাথায় পড়লেই হাঁচি। ওর মন খারাপ হতো। প্রিয় বান্ধবীকে বলার জন্য কত কথাই না জমিয়ে রেখেছিল। কথা হয়তো বৃষ্টিতে ভেসে যায়। পরে আর বলাই হয়নি।
ডান পাশ ফিরে শুয়ে থাকে মেয়েটি। চোখ খোলা। দৃষ্টির সমান্তরালে আধখাওয়া মিষ্টির প্লেটে লাল পিঁপড়ার সারি। মোবাইল ফোন ঘেঁষে চলে গেছে। কার্পেটের ওপর বিস্কিটের গুঁড়া। বিস্কিট খেয়ে সে কি গুঁড়াগুলো ঝেড়ে ফেলেছিল? কিন্তু কার্পেটের ওপর কেন ফেলবে? কার্পেটটা তাকেই পরিষ্কার করতে হয়। জেনেবুঝে নোংরা করার কারণ নেই। মেয়েটি বিছানায় না শুয়ে সোফায় কেন শুলো সেটাও মনে করতে পারে না। আড়মোড়া দিয়ে সে উঠে বসে। হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো করে সোফার ওপরই বসে থাকে। সারা বাড়ি নিঝুম। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। সকাল না বিকেল ঠাহর করা যায় না। ঘোলাটে আলোয় সে ধরে নেয় সকাল হয়েছে। ওর স্বামী এতক্ষণে অফিসে চলে গেছে। যাবার আগে ডেকে দিলেই পারতো। হয়তো দেরি হয়ে যাচ্ছিল। অনেকটা দূরেই অফিস। বাসে তারপর রিকশায় দু’বারে যেতে হয়। মিষ্টির প্লেটও সরিয়ে রাখেনি। সোফায় বসেই মেয়েটি দেয়ালের ঘড়িতে তিনটা পনের দেখতে পায়।
“দিনটা অন্য রকম” বলতে বলতে সে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। ইশ! সোফা আর কার্পেটের অনেকটুকু ভিজে গেছে। জানলার দুটো পাল্লা টেনে দেয় সে। কাচের ওপাশে নুয়ে পড়া দোপাটি গাছ ঝাপসা হয়ে আসে। সে কুশন তুলে রাখে সোফার ওপর। তিনটা পনের। এ সময় ঘুম থেকে জেগে কী করবে সে ভেবে পায় না। ফোনে চার্জ নেই। বন্ধ ফোন গালে ঠেকিয়ে মেয়েটি বসে থাকে। হয়তো সে লক্ষ্য করেছে ইদানীং ফোন এলে পুরুষটি ফোন হাতে অন্য ঘরে চলে যায়। কাজের পর যতটুকু অবসর মেসেঞ্জারের নীল বাক্সেই। মেয়েটি বিষণ্ণ হয়ে যায়।
বসার ঘরের জানলাটা লাগাতে গিয়ে পুরুষটি দেখে মেয়েটি সোফায় বসে আছে। মেয়েটিও পুরুষটিকে দেখে। এমন পরিস্থিতিতে কী বলা যায় দুজনের কেউ ভেবে পায় না। যেন এ মুহূর্তে দুজনেরই ঘরে থাকা স্বাভাবিক। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। সব কথা যেন ঘুমিয়ে গেছে কিংবা এখনও ওদের মতো ঘুম ভেঙে কথারা জেগে ওঠেনি। ওদের মাছের মাথা আর লেজ নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই। আদা আর কাঁচকলার ঝগড়া নেই। ঘুমানোর সময় আলো জ্বলা-নেভার বিরোধ নেই। তবু কোথায় যে কী ফাটল ধরে আর হুহু করে অদৃশ্য পানি ঢুকে দুজনকে বানভাসী করে দেয়। সমাপ্তির আগেই ওরা হারিয়ে ফেলে নিজেদের।
“ফোনের চার্জ শেষ।” আগে কথা বলে মেয়েটি।
“আমার ফোনও চার্জে দিলাম।” পুরুষটি দেখে জানলা লাগানো। সে আর বলে না এ ঘরে জানলা লাগাতে এসেছিল। বলে “রাতে এ ঘরে ঘুমিয়েছিলে?”
“কেমন করে এ ঘরে এলাম কে জানে। আমার তো ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস নেই।” মেয়েটি অপ্রস্তুত হয়ে হেসে ফেলে। পুরুষটিও বোকা বোকা হেসে বলে “আমিও মেঝেতে ঘুমিয়েছি। বিছানা থেকে পড়ে গেছিলাম নাকি? পড়ে গেলে অবশ্য ঘুম ভেঙে যেত।”
দুজনেই এবার একসাথে হেসে ওঠে। মেয়েটির ঠোঁটে গোলাপি আভা আর ঠোঁটের কোণে অভিমানী রেখা দেখে পুরুষটি। যদিও চোখের নিচে গভীর ক্লান্তি। পুরুষটির মনে হয় সম্পর্কের শেষ হয়ে আসাটা মানুষ বোঝে। ফুরিয়ে যাওয়া টের পায়। তখন মানুষ কাঁদে। মেয়েটির মনে হয় মানুষ ভুলের সংকলন। এর বাইরে যাবার জায়গা নেই। পুরুষটি উঠে যায়। চায়ের পানি বাড়াতে হবে। কল বেল শুনে মেয়েটিও উঠে দাঁড়ায়।
ময়লা নিতে এসেছে সিটি কর্পোরেশনের ছেলেটা- “আজকে ময়লা দিবেন? তিন দিন ময়লা দেন না।” মেয়েটি চমকে ওঠে। তিনদিন! ছেলেটা দেদার কথা বলে- “শুক্র, শনি, রবি। আজকে হইল সোমবার। তিন দিন ধইরা বিষ্টির থামাথামি নাই। খালি বাড়ে কমে। আকাশ ফুডা হইয়া গেছে।” পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ছাতার পানি ঝরে দরজার সামনেটা ততক্ষণে ভিজে গেছে।
বারান্দার ভেজা কাপড় ঘরে নিয়ে আসে মেয়েটি। ছাদ থেকেও আনে। খাবার ঘরের দু’দিকে দড়ি মেলে না-শুকানো কাপড় ঝুলিয়ে দেয়। কিছু কাপড় মেলে দেয় বসার ঘরের দড়িতে, কিছু শোবার ঘরে। তারপর পাখা চালিয়ে দেয়। অথচ তিন দিন আগেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২/৩৩ এর মধ্যে ওঠা নামা করছিল। অনুভূত হয়েছিল আরও কয়েক ডিগ্রী বেশি। রাজধানীতে আজ তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা বলেছে গরমের মধ্যে এই বৃষ্টি নগরবাসীর জন্য স্বস্তিদায়ক। টানা বৃষ্টি থাকবে আরও তিন দিন। নগরবাসীর স্বস্তিটুকু চা পানরত দুজনের মধ্যে দেখা যায় না। পুরুষটি ফোন অন করতেই কল আসে। ফোন হাতে সে আজ অন্য ঘরে চলে যায় না। দু’দিন মেডিকেল লিভের কথা বলে লাইন কেটে দেয়। মেয়েটির অনেক দিন পর ভালো লাগে। আনমনে সে ব্রেডে মাখন লাগায়। মেয়েটির ফোনও বেজে ওঠে। হ্যালো হ্যালো বলে সে। ওপাশে চুপচাপ। “ফোন করলেন… কথা নেই? ঠিক আছে” এই বলে মেয়েটি কল কেটে দেয়। পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে কামড় দেয়। চা সত্যিই ভালো হয়েছে। মেয়েটা সে কথা জানাতে ভোলে না। শুধু পাউরুটি ওভার টোস্টেড হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা সে বলে না। বলে “দরজার সামনে একটা পাপোষ দিতে হবে।” পুরুষটি বলে “বৃষ্টির সময় ঘরে পোকামাকড় হয়। তুমি তো ফিনাইলের গন্ধ সহ্য করতে পারো না! লাইজল কিনতে হবে।”
মেয়েটি বলে “আমরা খুব ঘুমিয়েছি।”
“ঘুম কোথায়?”
“আজ ২১ জুন। টানা তিন দিন কীভাবে দুজন মানুষ ঘুমায়?”
“কত কিছুই আমরা জানি না।”
“আমরা দুজন কি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম?”
“দু’জন একই দিনে? এক সাথে কিন্তু দুই রুমে? সম্ভব?”
“না। আমি তো খাইনি। মেয়েটি নিচের ঠোঁট কামড়ে কী যেন চিন্তা করে।”
“আমিও না।”
“তাহলে?”
“তাহলে কত কিছুই হতে পারে। কন্সপিরেসি থিওরি ব্যাপারটার জন্মই হয়েছে এভাবে।
ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে মেয়েটির বিপন্নতা বাড়ে। কেমন এক ভরশূন্য অনুভবে ওর দুটো হাত অসাড় হয়ে আসে। চায়ের কাপটাকে ভীষণ ভারী মনে হয়। নামিয়ে রেখে ফের সে জিজ্ঞেস করে “বৃষ্টির সাথে কি ঘুমের যোগ আছে? ১৮ জুন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে।”
“এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। তুমি কি এখনো ঘুমাচ্ছ?”
“কি জানি! পাতা আর বৃষ্টির কী এক স্বপ্ন দেখছিলাম। নাকি বৃষ্টিটা বাস্তব, স্বপ্নটা শুধু পাতার? শোনো না… গুগল করেছিলাম। বাতাসে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে…”
“মানুষ টানা তিন দিন ঘুমায়?”
মেয়েটির ভীষণ রাগ লাগে। পুরুষটির নির্লিপ্তভাবটা ভালো লাগে না। শান্ত গলায় সে বলে “আচ্ছা এই মুহূর্তে তোমার কিছুই মনে হচ্ছে না? কোনো প্রশ্ন নেই?”
পুরুষটি হেসে ফেলে “আছে। ঘুমের ভেতর ঠোঁট এতো নরম আর গোলাপি হয় কীভাবে?”
মেয়েটি অস্বস্তিটুকু লুকাতে পারে না। বিহ্বলতাটুকু আড়াল করে বলে “অনেক ভাবেই।” তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে পুরুষটির চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। গাঢ় স্বরে বলে- “নিভিয়া ক্রিমের সাথে পেট্রোলিয়াম জেলি মিশিয়ে অল্প গরম করে গলিয়ে নিতে হয়। পুরু করে ঠোঁটের ওপর সারারাত লাগিয়ে রাখলেই…”
দমকা হাওয়ায় হঠাৎ বদ্ধ জানলা খুলে যায়। খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির ধোঁয়াশা উড়নি ওড়ে। মেয়েটি ভাবে দিনটা আসলেই অন্য রকম। পুরুষটির মনে হয় কী যেন বদলে গেছে। সারা বাড়ি জুড়ে মেলে দেয়া কাপড়গুলো হাওয়ায় উড়ছে অথচ দুজনের কেউই উঠে জানলা বন্ধ করে না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন