শেলী শাহাবউদ্দিন
অ্যান্ড্রোমেডা নক্ষত্রপুঞ্জের ‘কোদন্ড’ গ্রহে যে অবিকল পৃথিবীর মতো মানুষের বসবাস আছে, সে কথা দুহাজার নব্বই সনের আগে কারো জানা ছিল না। দুহাজার পঞ্চাশ সনে বাঙালি অধ্যাপক রেনেসাঁ চৌধুরী যখন প্রথম এই গ্রহটি আবিষ্কার করেন, তখন থেকে দুহাজার পঁয়ষট্টি সনে তার মৃত্যু অবধি অধ্যাপক চৌধুরী এবং পৃথিবীর কোনও বৈজ্ঞানিকই এই সম্ভাবনার কথা ভাবেননি। কিন্তু তারা কোদন্ড গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনার প্রমাণ পেয়েছিলেন। কী ভেবে অধ্যাপক চৌধুরী গ্রহটির নাম ‘কোদন্ড’ রেখেছিলেন, সে সম্বন্ধে বিতর্ক রয়েছে। অধ্যাপক চৌধুরী এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কখনও কিছু বলেননি৷ কোন কোন বিশ্লেষক মনে করেন, কোদন্ড শব্দের যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করা যায় এবং অধ্যাপক চৌধুরী হয়ত কোদন্ড গ্রহে কোনও গভীর রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলেন, সেই হেতু এই নাম রেখেছিলেন।
যাই হোক, দুহাজার পঁচানব্বই সনের ছাব্বিশে মার্চ কোদন্ড গ্রহের প্রথম অভিযাত্রী দল পৃথিবীতে তাদের প্রথম মিশন নিয়ে অবতরণ করে। এই দলের মধ্যে ছিল সাতাশ বছর বয়সী, অপূর্ব সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী নক্ষত্ৰচারী হিহি৷ ত্রিশ বছর বয়সী বাঙালি ছেলে অধি ছিল একজন আন্তগ্রহ-যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। এরা দুজন দেখা হওয়া মাত্র একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। সে ছিল এক আশ্চর্য রোমাঞ্চকর ঘটনা। আরো রোমাঞ্চকর এই যে তারা পরস্পরের জন্য মরতেও রাজী ছিল। পৃথিবীর জন্য এটা স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু কোদন্ড গ্রহে এরকম কথা কেউ কোনদিন শোনেনি। সেখানে সবকিছু লাভ-ক্ষতির হিসেবে করা হয়। তাদের প্রধান দেবতার নাম ‘ঠিঠি। পৃথিবীর ভাষায় যার অর্থ ‘লাভ’! এ ইংরেজি ভাষার ‘লাভ’ নয়; এর অর্থ মুনাফা। হিহি ও অধির বিয়ের দিন ঠিক করা হয় ৪ঠা জুলাই। খুবই শুভ দিন- এক বছর আগে ওইদিন শেষ প্রজন্মের ‘মনভ্রমণ মহাশূন্যযান’-এ করে পৃথিবীর অভিযাত্রীরা কোদন্ড গ্রহে প্রথমবার গিয়ে পৌঁছান। কাজেই ওই শুভদিনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুভক্ষণে হিহি ও অধির শুভ পরিণয় হবে৷ কোদন্ড গ্রহের রীতি অনুযায়ী বিয়ে হবে বরের বাড়িতে। অধির বাবা-মা’র ঘোর আপত্তি ছিল এই বিয়েতে৷ কিন্তু হিহির জন্য অধি সব করতে পারে। বাবা-মা যখন কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না, তখন অধি তার পুরনো অস্ত্র বের করে। সে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে। সাতদিন না খাওয়ার পর তার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। একমাত্র ছেলের অক্ষিগোলকের কোটরগত অবস্থা দেখে শেষে বাবা-মা রাজী হয়ে যান।
পৃথিবী আর কোদন্ড গ্রহের মধ্যে এই প্রথম বিয়ে। ধুমধামের কথা বলাই বাহুল্য! ঠিক হয়েছে কোদন্ড-প্রধান এবং পৃথিবী-প্রধান উভয়েই এই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তবে নিরাপত্তার কারণে কোদন্ড-প্রধান এই বিবাহে যোগদান করবেন কোদন্ড গ্রহ থেকে তৃতীয় মাত্রার দূরচিত্রবিক্ষণের মাধ্যমে। সারা পৃথিবীতে বিয়ের জন্য সাজ সাজ রব। কিন্তু হঠাৎই এক অচিন্তনীয় সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেহেতু কোদন্ড-প্রধান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন, সেহেতু তিনি চান যে পৃথিবীবাসীরা নিজেদের খুব খারাপ প্রথাগুলি পরিবর্তন করুক, যেগুলি কোদন্ড মতে মোটেই ভাল মনে হয় না৷ কোদন্ড পুরোহিতরা মনে করেন যে পৃথিবীর বেশীরভাগ নিয়মকানুনই ভাল নয়। কোন কোন নিয়ম ভগবান ঠিঠি একসময় খুবই পছন্দ করতেন, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক এখন আর করেন না৷ ভগবানের লীলা বোঝা দায়! যাই হোক, যতদিন পৃথিবী ও কোদন্ডের মধ্যে কোনও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না ততদিন তারা পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় বিরত ছিল। কিন্তু এখন সে অবস্থা বদলাতে চলেছে, অর্থাৎ পৃথিবীকেও বদলাতে হবে। কোদন্ড-প্রধান হিহির মাধ্যমে পৃথিবী-প্রধানকে একটি প্রস্তাব পাঠালেন, হিহি সেটি অধির হাতে ধরিয়ে দিল পৃথিবী-প্রধানকে দেবার জন্য। অসংখ্য প্রস্তাব, অধিকাংশই মনে হয় ঠিঠি দেবতাকে প্রসন্ন করার জন্য। পৃথিবী-প্রধান তার পরামর্শদাতাদের সঙ্গে কথা বলে একটা পাল্টা প্রস্তাব পাঠালেন ৷ আন্তঃগ্রহ যোগাযোগের চতুর্মাত্রিক মেধা হিসেবে পৃথিবীর কাছে অধির গুরুত্ব অপরিসীম, তাছাড়া পৃথিবী-প্রধান অধিকে বিশেষ পছন্দ করেন।
পৃথিবী কোদন্ডের সকল প্রস্তাব মানতে রাজী ছিল শুধু একটি প্রস্তাব ছাড়া, সেটি ছিল পৃথিবীতে অপরাধী যত খারাপই হোক তাকে প্রাণদন্ড দেওয়া যাবে না, এমনকি সে যদি মানবতা বিরোধী অপরাধ করে থাকে তাহলেও নয়। আশ্চর্য বিষয়, কোদন্ড গ্রহে অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রাণদন্ড প্রথা প্রচলিত ছিল; শুধু তাই নয়, একসময় ঠিঠি দেবতার জন্য গণহারে নরবলি দেওয়া হত। কিন্তু হঠাৎ কোদন্ড পুরোহিতরা জানতে পারেন যে ঠিঠি দেবতা আর নরবলি পছন্দ করেন না।
পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকরা গবেষণা করে আরো জানতে পারে যে ঠিঠি দেবতা যুদ্ধ-বিগ্রহ পছন্দ করেন। তিনি চান মানুষরা যুদ্ধের মাধ্যমে একজন আর একজনকে মেরে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করুক। ফলে কোদন্ড পুরোহিতরা এখন দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং ভূখন্ডগুলির মাঝে যুদ্ধ বাধাবার কাজে অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন৷ এজন্য তারা যুদ্ধরত দলপতিদের উদার হাতে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য করেন। পৃথিবী-প্রধান দূতের মাধ্যমে কোদন্ড-প্রধানকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে পৃথিবীর এই নিয়ম পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কিছু কিছু জটিল, গভীর ও দুর্বোধ্য কারণে পৃথিবীর বড় বড় অপরাধী, বিশেষ করে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বেশীদিন কোন জেলখানায় আটকে রাখা যায় না ৷ অতীত ঘটনার ইতিহাস নিয়ে লেখা বড় বড় বই এবং তার বিশ্লষণ ও গবেষণার কাজ পৃথিবী থেকে পাঠানো হ’ল কোদন্ড-প্রধানের কাছে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! কোদন্ড-প্রধান কিছুতেই মত বদলাতে রাজী হলেন না, হয়ত পুরোহিতদের অমতে তাঁর পক্ষে রাজী হওয়া সম্ভবও ছিল না। উপায়ান্তর না দেখে পৃথিবী-প্রধান হিহি ও অধিকে ডেকে জানিয়ে দিলেন যে এ বিয়ে হবে না। হিহি ও অধি প্রথমে খুব মুষড়ে পড়ল, তবু তারা হাল ছেড়ে দিতে রাজী নয়। দুজনে মিলে মাথা খাঠিয়ে একটা বুদ্ধি বার করল৷ তারা একটা পাল্টা প্রস্তাব লিখে পৃথিবী-প্রধানের কাছে নিয়ে গেল ৷ সেই প্রস্তাব পড়ে পৃথিবী-প্রধান কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “কোদন্ড-প্রধান এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। তখন তোমরা কি করবে?”
“আমরা তাঁকে আসলে দু-ধরনের প্রস্তাব দেব। এক, পৃথিবীর প্রস্তাব মেনে নেওয়া আর নয়তো দুই, বিয়ের প্রস্তাব মেনে নেওয়া।” জানাল অধি।
“তিনি তো দুটো প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিতে পারেন।”
“আমরা মনে করছি তিনি তা করবেন না। যেখানে পৃথিবী অধিকাংশ কোদন্ড-প্রস্তাব মেনে নিতে রাজী, সেখানে কোদন্ড-প্রধান যদি কোনও প্রস্তাবই না মানেন, তাহলে কোদন্ড সমাজে তিনি সম্মান হারাবেন।” এবার উত্তর দিল হিহি।
“কিন্তু কোদন্ড-সমাজ জানবে কী করে যে আমরা এই প্রস্তাবগুলি পাঠিয়েছি? শুনেছি কোদন্ড-সমাজে গণমাধ্যম খুবই সমৃদ্ধ, কিন্তু পুরোহিতদের ক্রুদ্ধ করে কোন কাজ তারা করে না।” পৃথিবী-প্রধান চিন্তিত ভঙ্গীতে প্রশ্ন করলেন।
এবার অধি কিঞ্চিত লজ্জিত হয়েই বলল, “একটা কথা আপনাকে জানানো হয়নি। আমি একটি নতুন প্রোগ্রাম তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে আমরা কোদন্ডে যোগাযোগের সকল সুরক্ষা ব্যবস্থা ডিঙিয়ে সেখানকার সাধারণ নাগরিকদের কাছে আমাদের প্রস্তাব একই সময় জানিয়ে দিতে পারব। গোপনীয়তার খাতিরে একথা এখনও আমার ওপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না। এইমাত্র আপনি জানলেন।”
“কোদন্ডের বৈজ্ঞানিকরা কি তোমার প্রোগ্রাম প্রতিহত করতে পারবে না?” পৃথিবী-প্রধান উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন৷
“সেটি সময়সাপেক্ষ। কোন এক সময় কোদন্ড বৈজ্ঞানিকরা নিশ্চয়ই আমার প্রোগ্রাম প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু যতদিন না সেটি হচ্ছে ততদিন আমরা যা চাই, তাই তাদের জনগণকে জানাতে পারি।” একগাল হেসে অধি ব্যাখ্যা করে। পৃথিবী-প্রধান হিহি আর অধিকে জড়িয়ে ধরলেন। আনন্দে তার দুচোখ চিকচিক করছে। বুঝলেন অধির ওপর তার বিশ্বাস অপাত্রে পড়েনি৷
পরিকল্পনা অনুযায়ী পৃথিবী থেকে কোদন্ডে প্রস্তাব পাঠানো হ’ল ৷ প্রস্তাব পড়ে কোদন্ড-প্রধানের আক্কেলগুড়ুম! শেষ পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর কাছে হার মানলেন। প্রাণদন্ডসহ পৃথিবী ও কোদন্ডের সকল নিয়ম রীতি অপরিবর্তিত রেখেই মহা ধুমধামের সঙ্গে ৪ঠা জুলাই হিহি ও অধির বিয়ে হয়ে গেল৷ বিয়ের পর কোদন্ড গ্রহের নিয়ম অনুযায়ী অধি আর হিহিকে কোদন্ডে থাকতে হবে। তবে
পৃথিবীতে অধিকে আরো দশ বছর কাজ করতে হবে, তাই সে তার শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে কথাবার্তা বলে পাঁচ বছর সময় চেয়ে নেয়। তারপরের পাঁচ বছর সে কোদন্ডে বসেই আন্তঃগ্রহ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর কাজ চালিয়ে যায়। বছরে একবার তাকে পৃথিবীতে গিয়ে সেখানে অতি গোপনীয় কাজগুলির জন্য মাস কয়েক থাকতে হয়। এই আসা-যাওয়া ছিল অত্যন্ত পরিশ্রম ও ব্যায়সাপেক্ষ।
৩০০৫ সনে অধি পৃথিবীর কাজে ইস্তফা দিয়ে স্থায়ীভাবে কোদন্ড গ্রহে অবস্থান শুরু করে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর পৃথিবীর রীতি-নীতি ছেড়ে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের সেই সম্পূর্ণ ভিন্ন গ্রহে বসবাসের কষ্ট সে শুধুমাত্র হিহির জন্য স্বীকার করে নেয়। হিহিকে সে এমনই ভালবাসে যে তার জন্য সে সবকিছু করতে পারে।
দাদা-শ্বশুর আর দিদি-শাশুড়ির কান্ডকারখানার এই রোম্যান্টিক রোমাঞ্চকর গল্প, যা ছিল পৃথিবী ও কোদন্ড গ্রহের দুই মানব মানবীর প্রেমের গল্প, সেসব আমি শুনি আমার স্ত্রী নিনির কাছে। তিন হাজার চল্লিশ সনে আমি পৃথিবীর এক সাংস্কৃতিক দলের প্রধান হয়ে কোদন্ড গ্রহে যাই। সেখানে আমার পরিচয় ও প্রেম হয় হিহি ও অধির নাতনি সঙ্গীত বিজ্ঞানী এবং গায়িকা নিনির সাথে। আমাদের বিয়ে হয় তিন হাজার ছেচল্লিশ সালে৷ বিয়ের পর নিনি আমাকে তাদের পারিবারিক সম্পদ, পৃথিবীর সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাবের মূল কপিটি দেখায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে কোদন্ড-প্রধান এই ঐতিহাসিক দলিলটি তার বংশধরদের সম্মানের কথা ভেবে লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে দিয়েছিলেন।
আমি দলিলটি পড়ে দেখি ভারি মজার প্রস্তাব। আমার দাদা-শ্বশুরের মেধার প্রশংসা না করে পারা যায় না। লিলির অনুমতি পাওয়ার পর কোদন্ড গ্রহের ইতিহাস ও নিরাপত্তা-প্রধানের অনুমতি নিয়ে আমি দলিলটি প্রকাশ করি। পরে মূল কপিটি নিনি পৃথিবীর প্রধান যাদুঘরকে দান করে। প্রস্তাবের বিবরণ নিচে দেওয়া হল:
১৩ই মে, ২০৯৫ সন। মহামান্য কোদন্ড-প্রধান: হিহি ও অধির বিয়ের শর্ত হিসাবে আপনারা পৃথিবীর কতকগুলি প্রচলিত আইন ও রীতিনীতি পরিবর্তন করবার জন্য দাবী করছেন। কিছু কিছু আইন ও রীতিনীতি পৃথিবীর সামাজিক অবস্থার মধ্যে প্রোথিত৷ সামাজিক শান্তি রক্ষার জন্য সে সকল আইন পরিবর্তন করা বিপজ্জনক; তবু আমরা একটি ব্যতীত সকল আইন ও রীতিনীতি পরিবর্তনে সম্মত হয়েছিলাম শুধুমাত্র হিহি ও অধির কথা ভেবে। তবুও আপনারা আপনাদের অবস্থানে অনড় রয়েছেন। যদি আমরাও একইভাবে আপনাদের কতকগুলি আইন, যেগুলি পরিবর্তন করা আপনাদের পক্ষে দুরুহ, সেগুলি পরিবর্তনের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করি তাহলে আপনারা আশা করি আপনাদের প্রস্তাবের অযৌক্তিকতা, অবাস্তবতা এবং বালখিল্যতা বুঝতে সক্ষম হবেন। যেহেতু আপনাদের কিছু আইন পৃথিবীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং বেদনাদায়ক, সেহেতু আমরাও সেগুলি পরিবর্তনের দাবী জানাতে পারি। কিন্তু আমরা মনে করি সেটি হবে আপনাদের গ্রহের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে পৃথিবীর হস্তক্ষেপ। আমরা অন্যের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা অন্যায় বলে মনে করি৷ তদুপরি আমরা মনে করি বিবাহ এবং অন্যান্য সকল আন্তঃগ্রহ সম্পর্কের খাতিরে পরস্পরের আগ্রহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হবে বিপজ্জনক, বোকামি এবং সেটি করা উচিতও নয়।
আপনার সহৃদয় বিবেচনার জন্য আমরা আপনাদের অল্প কয়েকটি আইন ও রীতিনীতি সংস্কারের ও পরিবর্তনের প্রস্তাব পাঠালাম। বলা বাহুল্য এসব প্রস্তাব আমাদের আসল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের আসল উদ্দেশ্য হিহি ও অধির বিয়ে।
প্রস্তাব তালিকা:
১) অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় ও রোগের চিকিৎসা পৃথিবীতে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। আপনারা তা মানে না। আপনারা মনে করেন মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাই মানুষের প্রধান মৌলিক অধিকার, বাকি সব তুচ্ছ। রোগের চিকিৎসাকে আপনারা কোন অধিকারের আওতায় ফেলেন না, ফলে অনেক কোদন্ডবাসীকে রোগের চিকিৎসার জন্য সর্বস্বান্ত হতে হয়। এই ব্যবস্থা অমানবিক, আমরা এই ব্যবস্থার পরিবর্তন দাবি করি।
২) মানবজাতি সমূলে ধ্বংস করতে পারে এমন যে কোনও ব্যবস্থাই মানবতাবিরোধী, সেজন্য অনর্থক বোমা এবং আর সকল ধংসাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র পৃথিবীতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আপনারা অনবরত বোমা বানিয়ে চলেছেন এবং তার চেয়েও ভয়াবহ বোমা বানাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বোমা মানব জাতির ধ্বংসসাধন ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য সাধন করবে বলে আমরা মনে করি না। যেহেতু পৃথিবীর ছেলে অধির সাথে আপনাদের মেয়ের বিয়ে হলে তারা কোদন্ড গ্রহেই বসবাস করবে, সেই কারণে তাদের এবং তাদের বংশধরদের কল্যাণের জন্য আমরা আতঙ্কিত ৷ আমরা আপনাদের সকল মানবতাবিরোধী অস্ত্র ও ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করার আবেদন জানাই।
৩) পৃথিবীতে এখনও প্রচলিত অস্ত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে পৃথিবীতে অস্ত্র বিক্রয় নিষিদ্ধ৷ কোদন্ড গ্রহে অস্ত্র বিক্রয় হয় এবং সন্ত্রাসবাদীরা সেগুলি সহজেই কিনতে পারে। ফলে এই আন্তঃগ্রহ ভ্রমণের যুগেও কোদন্ড গ্রহে নিরীহ নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে দলে দলে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে প্রতিদিন নির্যাতিত ও নিহত হয়। আমরা শুনেছি কোদন্ড গ্রহের কোন কোন অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদীরাই সরকার গঠন করেছে। আমরা অস্ত্র বিক্রয়ের অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ করার দাবী জানাই।
৪) একইভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমরা অস্ত্র বিক্রয়কে মানবতা বিরোধী মনে করি। কোদন্ড গ্রহের স্কুলগুলিতে বিপথগামী অথবা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের হাতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা অবশ্য একথাও জানি যে কোদন্ড-প্রধান ব্যক্তিগত পর্যায়ের অস্ত্র বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, যার মূল কারণ অস্ত্র বিক্রয়ের লাভজনক ব্যবসা। পৃথিবীতে এই লাভজনক ব্যবসা বন্ধ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য যাদের অস্ত্র প্রয়োজন, সরকার তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। প্রয়োজন হলে অল্প সময়ের আত্মরক্ষার জন্য বিশেষ ক্ষেত্রে অস্ত্র ধার দেওয়া হয়, বিক্রি করা হয় না। সকল অস্ত্র বিক্রয় নিষিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন৷
৫) পৃথিবীর মানবাধিকার সংগঠনগুলি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় ও চিকিৎসা সেবার জন্য পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করে। কোদন্ড গ্রহে মানব-অধিকার সংগঠনগুলি এসব বিষয়ে আগ্রহী নয়। তারা কাজ করে মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা এবং যুদ্ধ-অপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মুক্তির জন্য। আমরা এই বিভ্রান্ত ব্যবস্থার কারণ বুঝতে পারি যখন দেখি যে বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠী এবং ‘লবি’ নামক তাদের পরিচারকেরা (আইনসম্মত ঘুষ ব্যবস্থাপনা সংগঠন) গোষ্ঠীগুলি এইসব সংগঠনের পেছনে অনবরত অর্থ ব্যয় করে চলেছে। এই মানবতা বিরোধী ব্যাবসা নিষিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
৬) কোদন্ড গ্রহে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি তাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা জোর করে দুর্বল রাষ্ট্রগুলির ওপর চাপিয়ে দেয়। ফলে দুর্বল রাষ্ট্রগুলিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং তাদের উন্নয়ন প্রতিহত হয়। সবল রাষ্ট্রগুলি এইভাবে নিজেদের জন্য দুর্বল রাষ্ট্র থেকে কাঁচামাল ও দাস সরবরাহ অটুট রাখে। পৃথিবীতে এখন এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত। আমরা এই ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করার দাবী জানাই।
৭) কোদন্ড গ্রহের সবল রাষ্ট্রগুলি দুর্বল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনেতাদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পদচ্যুত বা হত্যা করে সেখানে নিয়মিত নিজের পছন্দমত লোক বসিয়ে দূর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে দাসরাজ্যে পরিণত করে এবং তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে। ফলে দুর্বল রাষ্ট্রের মানুষেরা মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। আমরা এই ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করার দাবী জানাই।
৮) পৃথিবীতে রোগে মরণাপন্ন মানুষকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশার বাণী শুনিয়ে মানসিক শান্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আসন্ন মৃত্যুর খবর জানানো হয় শুধু তার প্রিয়জনকে। কোদন্ড গ্রহে মরণাপন্ন রোগীকে সরাসরি দুঃসংবাদ জানানো হয়। এ হ’ল মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। আমরা এই ব্যবস্থাকেও অমানবিক মনে করি এবং তা নিষিদ্ধ করার দাবী জানাই।
সর্বশেষে আমরা কোদন্ড গ্রহের আর একটি উদ্ভট বিষয়ের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, বিষয়টি এতই অদ্ভুত যে এই মুহুর্তে সে ব্যাপারে আমাদের বিভ্রান্তি ছাড়া অন্য কোন ধারণা নেই। বিষয়টি হ’ল ‘ব্যক্তিগত শূন্যস্থান’ (পার্সোনাল স্পেস)। কোদন্ড গ্রহে মানুষ মানুষের খুব কাছে যেতে পারে না। তাকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের শূন্যস্থান বজায় রেখে চলতে হয়, তা যত ঘনিষ্ঠতাই থাকুক না কেন। স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা প্রয়োগ করা বাস্তবে অবশ্যই সম্ভব নয়।
পৃথিবীতে বন্য প্রাণীদের সাথে মানুষ এ ধরনের শূন্যস্থান বজায় রেখে চলে৷ বন্য প্রাণীরাও পরস্পরের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে। অবশ্য বন্য প্রাণীরা যখন একজন আর একজনের খাদ্যে পরিণত হয় তখন এই শূন্যস্থান আর রক্ষা করা সম্ভব হয় না ৷ ফলে কোদন্ড গ্রহের এই ব্যক্তিগত শূন্যস্থানের ব্যবস্থা পৃথিবীর মানুষকে ভীত ও বিভ্রান্ত করে। এই ব্যবস্থার অর্থ কী? এই ব্যবস্থা কি ইঙ্গিত করে যে কোদন্ড গ্রহে সময় ও ব্যক্তিবিশেষে এক মানুষ অন্য মানুষের খাদ্যে পরিণত হতে পারে বা হয়; এবং সেইজন্যই এই ব্যক্তিগত শূন্যস্থানের প্রয়োজন?
আশা করি আপনি আমাদের বুঝিয়ে বলবেন এবং আমাদের সন্দেহ ও আশঙ্কা দূর করবেন। হিহি ও অধির বিয়ে প্রসঙ্গে আপনার সহৃদয় বিবেচনা ও প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্তের জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষামান রইলাম।
বিনীত
স্বাক্ষর: পৃথিবী-প্রধান
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন