সেলিনা হোসেন
ঝর্ণার বয়স বাড়ে, কিন্তু শরীর বাড়ে না। শেষ পর্যন্ত ও একটি বামন মেয়ে হয়ে থাকে।
বুঝতে শেখার পর থেকে এ নিয়ে ওর দুঃখের শেষ নেই। একজন মেয়ে এভাবে বড় হলে তার নিজের কিছু করার থাকে না। কিন্তু বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী যখন নানা কথা বলে তখন ওর সামনে দুনিয়া ভেঙে আঁধার নামে। ও কেঁদেকেটে নিজেকে অস্থির করে তোলে।
শুনতে পায় অন্যদের অদৃশ্য কণ্ঠ, “তুই একটা আজগুবি মেয়ে।” আজগুবি মেয়ে? এটা আবার কেমন? বললেই হলো? আমার মাথা ঠিক আছে। আমি সবার মতো সবকিছু বুঝতে পারি।
শুনতে পায় বান্ধবীদের কণ্ঠস্বর, “তুই সবার মতো না। বামন ছেড়ি, বামন। তোকে বেঁচে থাকতে হলে অন্যের দয়া ও করুণার ওপর বেঁচে থাকতে হবে। তুই এই সমাজের বোঝা।”
“বোঝা!” আঁতকে ওঠে ঝর্ণা। “বোঝা হবো কেন? আমি কি কিছু করতে পারবো না? আমি কাজ করে ভাত খেতে পারব। আমি কারও বোঝা হব না।” বাবা-মা যখন বিষণ্ণ মুখে ওর দিকে তাকায় তখন ওর ক্রোধ বাড়ে। মাঝে মাঝে ও ভীষণ খেপে যায়। বাবা-মাকে চিৎকার করে বলে, “আমাকে নিয়ে যদি তোমরা বেশি ভাবো তাহলে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো। আমি তোমাদের বোঝা হবো না। দেখে নিও কোনদিনই বোঝা হবো না।”
বাবা হারেছ আলি মাথায় হাত দিয়ে বলে, “শান্ত হ মা। বুঝিস তো সব বাবা-মা চায় যে তার ছেলেমেয়ে ভালো থাকুক। ওর মা বলে, আমরা তোর ভালো চাই মা। তুই সুখে থাকবি, শান্তিতে থাকবি।” “তাহলে আমার জন্য একটা কাজ করেন আপনারা। সবাইকে বলেন, আমাকে নিয়ে যেন কথা না বলে। তাহলেই আমি শান্তিতে থাকতে পারবো। ছেলেমেয়েরা আমাকে টিটকারী দেয়, মুরুব্বীরা গালমন্দ করে – এসব শুনলে আমার খুব কষ্ট হয় মা। আমার শরীরটা এমন হয়েছে তার জন্য কি আমি দায়ী? বলেন কে দায়ী?”
বাবা-মা মেয়েটার বুদ্ধি দেখে অবাক হয়। কে দায়ী একথা বলার সাধ্য কি তাদের আছে? ওর সামনে চুপ করে থাকে তারা। বেশিরভাগ সময় ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। গায়ে-পায়ে এমন গাটটু হলে কি হবে মাথা ওর ভালোই সচল। তারপরও মেয়েটাকে নিয়ে নানাজনের নানাকথা। বাবা-মায়েরও ভালো লাগে না শুনতে। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল। ছেলেমেয়েদের নানা কথায় মেয়েটি ক্লাস ফাইভের পর আর স্কুলে যেতে চায়নি। পড়ালেখাও শিখতে পারল না। মা আসফানি ওর জেদ দেখে অবাক হয়। যেটা ও না বলে, তারপর আর হ্যাঁ করে না। বাড়িতে বসে নিজের মতো সময় কাটায় ঝর্ণা। একা একা খেলে। হাঁড়িকুড়ি নিয়ে ভাত রান্না করে, ধুলোবালির ভাত। ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে। কাগজের নৌকা বানিয়ে পুকুরে ভাসায়। কখনো বাবার সঙ্গে ক্ষেতের কাজে যায়। বাবা কৃষিকাজ করে। ওরা নয় বোন দুই ভাই। ওর স্থান সাত। আর কেউ ওর মতো নয়। সবাই সুস্থ, স্বাভাবিক। বোনদের বিয়ে হয়েছে। যে যার মতো সংসার করছে।
ওর গ্রামের নাম গড়ের গাঁও। গ্রামটিকে ওর খুব ভালো লাগে। দূরে তাকালে পাহাড়ের মাথা দেখা যায়। পাহাড়ের মাথায় নীল কুয়াশা লেগে থাকে। স্বপ্নের মতো মনে হয় তখন। ওর ওই পাহাড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়। বাবা বলে, “ওই পাহাড়ের নিচে পৌঁছানো যাবে না। আর পাহাড়ের মাথায় তো উঠতেই পারবি না।”
“কেন যেতে পারবো না আব্বা?”
“সেতো অনেক দূর।”
“কত দূর আব্বা?”
হারেছ আলি বলে, “আমি নিজেও জানিনা রে কত শত মাইল পার হতে হবে। ছোটবেলা থেকে কোন দিন ওই গেরামে যাইনি। আজকে তুই আমার চোখ খুলে দিলি।”
ঝর্ণা হাততালি দিয়ে ঘুরপাক খেয়ে বলে, “আব্বা চলেন আমি আর আপনি হেঁটে হেঁটে চলে যাই। যতদিন লাগে লাগুক। আমরা চিড়া-মুড়ি-গুড় সঙ্গে নিবো। খিদে লাগলে খাবো। রাস্তার ধারের ডোবা থেকে পানি খাবো। ফলমূল থাকলে পাড়বো। গাছের নিচে ঘুমাবো।”
হারেছ আলি হাসতে হাসতে বলে, “থাম, থাম মা।”
“কেন থামবো। যাবেন না আব্বা?”
“পাগলা মেয়ে। আমার তো পায়ে জোর নাই। আমি কি তোর মতো হাঁটতে পারবো? বুড়া হয়েছি না।”
“বুড়া হলে কি মানুষের শক্তি কমে? একটুও না। আমার সঙ্গে আপনাকে যেতেই হবে। আমরা একদিন হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের কাছে যাব।”
“এখন আমাকে কাজ করতে দে।”
হারেছ আলি ধমকের সুরে বলে। ঝর্ণা খুব মন খারাপ করে। বাবার উপর রাগ হয়। বাবা বুড়ো না হলে ঠিকই ও পাহাড়ের কাছে বাবাকে নিয়ে পৌঁছে যেতো। বাবাও দেখতো কি সুন্দর পাহাড়!
ও আর বাবার দিকে তাকায় না। ক্ষেতের ধারে বসে মাটির গুটি নিয়ে খেলতে খেলতে কোঁচড় ভর্তি করে শাক ওঠায় ও। বাড়ি এসে মাকে বলে, “মা শাক ভাজি করো। আজ আমরা শাক ভাত খাবো।”
মা ভাবে, মেয়েটার কত বুদ্ধি। মেয়েটা যদি অন্য সবার মতো হতো তাহলে ও একটা কাজের মেয়ে হতো। এখন আর কী করা! ও তো নিজেই লেখাপড়া করতে চাইল না।
চৌদ্দ বছর বয়স হয়েছে। এখনই বিয়ের সময়। লুকিয়ে বিয়ে দিতে হবে। নয়তো গোপনে কাজীকে টাকা দিতে হবে। বয়স কম থাকতে ওকে বিয়ে দিতে হবে। শুরু হয় পাত্র খোঁজা। শেষ পর্যন্ত পাঁচ কাঠা জমি লিখে দেওয়ার শর্তে ঝর্ণাকে বিয়ে করতে রাজি হয় হাশেম মিয়া। শুনে ঝর্ণার ভীষণ মন খারাপ হয়। ছুটে যায় মায়ের কাছে।
“মা এটা কেমন কথা? আমার জন্য তোমরা জমি দিয়ে জামাই কিনবে?”
“তোরে তো আমরা বিয়ে দিতে চাই মা। মেয়ের বিয়ে দিতে না পারলে বাবা-মা বেহেশতে যেতে পারে না।”
“বেহেশতে!” ঝর্ণা ভুরু কুঁচকে তাকায়।
“মেয়ের বিয়ে দিতে না পারলে বাপ-মায়ের গুণাহ্ হয়।”
“গুনাহ্!” অস্ফূট স্বরে বলে, কিন্তু আর কথা বাড়ায় না। নিজেও এমন কথা শুনে দমে যায়। তারপরও বাবার কাছে গিয়ে বলে, “আব্বা আপনার জমি।”
বাবা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “তুই শ্বশুরবাড়িতে ভালো থাকবি এটা আমরা দেখতে চাই মা।”
ও মাথা নিচু করে। মনে মনে লজ্জাও পায়। ওর এই বামন-শরীর নিয়ে কোন পুরুষ মানুষ কি খুশি হবে? এমন কোন ধারণা করার মতো বড়ইতো হয়নি ও। ছুটে যায় পুকুরের ধারে। বঁড়শিতে আধার লাগিয়ে মাছ ধরতে বসে। মাছ ধরার খেলাটা দারুণ! যখন মাছ আধারে ঠোক্কর দেয় আর ফাতনা নড়ে এবং টান দিলে মাছ উঠে আসে সেটার মতো খুশি আর কোন কিছুতে হয় না। সেদিন অনেকগুলো মাছ ওঠে ওর বড়শিতে। মায়ের কাছে এনে মাছগুলো ঢেলে দিলে মা বলে, “ও আল্লাহরে আমার মাইয়াটার ভাগ্য কত ভাল। বিয়ের কথা হয়েছে। আর মেয়েটার বঁড়শিতে কত মাছ উঠছে। আল্লাহ ওর কপালে সুখই লিখেছে।”
মা ওকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়। আর ও ভাবে এমন একটা বামন-শরীর নিয়ে সত্যি কি ওর কপালে সুখ আছে? ও শুধু দেখতে পায় ওকে নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। বাবা-মা এখন পাড়া-পড়শীর মুখের ওপর ঠাস-ঠাস জবাব দেয়। এখন আর ভুরু কুঁচকে, চেহারা অন্ধকার করে বসে থাকে না। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে কুঁকড়ে যায় ঝর্ণা। যে ওকে বিয়ে করছে সে কি ওকে সত্যি ভালোবাসা দেবে? যত্ন-সোহাগ করবে? ভাবনা শেষ হয় না। ভয়ে মিইয়ে যায় ও। বাড়ির বাইরে এসে জাম গাছের নিচে বসে থাকে। অনেক দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আকুল হয়ে কাঁদে। এই দুনিয়া কি শুধু লম্বাদের জন্য? ওর মতো বামনদের জন্য না? ও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলে ছুটে আসে আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা। নিপু জিজ্ঞেস করে,
“তোর কী হয়েছে ঝর্ণা?”
ও চোখ মুছে বলে, “সাপে কামড় দিয়েছে।”
“সাপ? সাপ কই? কোথায় কামড় দিয়েছে?”
“আমার মাথার ভেতরে।”
ঝর্ণা কারো দিকে না তাকিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করে ছেলেমেয়েরা। একসময় ওরা আর ঝর্ণাকে দেখতে পায় না। ও গাছ-গাছালির আড়ালে হারিয়ে যায়। একজন বলে, “কোথাও তো সাপ নাই। ও সাপের কথা বলল কেন?”
“বামনটা পাগল একটা।”
“পাগল না রে ওর মাথায় অনেক বুদ্ধি আছে।”
“ছাই আছে। গাটটু একটা।”
“কয়দিন পরে ওর বিয়ে হবে রে।”
হাততালি দিতে দিতে ওরা ছুটোছুটি করে। দূর থেকে ওদেরকে দেখতে পায় ঝর্ণা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে, ওরা চলে গেলে তারপর ও বাড়ি ফিরবে। ওদের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয় না।
একদিন বিয়ে হয়ে যায় ঝর্ণার। আদর-সোহাগের কথাটথা নেই। কুপি নিভিয়ে বিছানায় টান হয়ে শুয়ে পড়ে হাশেম। ও ভেবেছিল, ওকে বুঝি রেহাই দেবে। কিন্তু তা হয় না। প্রবল পীড়ন ওকে কাঁদিয়ে দেয়। সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটায়। সকালে ওর ঝিমুনি পর্যন্ত আসে না। নতুন ঘরবাড়ির নতুন মানুষেরা ওর চারপাশে – সবার চোখে কৌতূহল। পেছন থেকে কেউ কেউ মন্তব্য করে,
“এমন মেয়ের বিয়েও হয়?”
“হাশেম মিয়া কি ওকে বিয়ে করেছে নাকি, বিয়ে করেছে ওর বাপের জমি? কদিন পরই টের পাবে বউটা।”
“ওইটা তো একটা লুচ্চা। বউটার কপালে দুঃখ আছে।”
নানা জনের নানা কথায় শক্ত হয়ে যায় ঝর্ণা। বুঝতে পারে সংসারে টিকে থাকার জন্য কঠিন লড়াই করতে হবে। কাউকে কিছু বলতে পারে না। স্বামীর লাম্পট্যের কথা শুনে লজ্জায় নত হয়ে যায় মাথা। বুঝতে পারে এমন কেউ বাকি নেই যে ওর স্বামীর এসব খবর রাখে না।
দু’মাসও ঠিকমতো থাকা হয় না। সংসার কী বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় নিপীড়ন। শরীর নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, গালমন্দ তো অনবরত চলে। ঝর্ণার কষ্ট হয় বাবা-মায়ের জন্য। মেয়ের সুখের জন্য জমি দিয়ে এখন চোখের জল ফেলছে। এর মধ্যে ও গর্ভবতী হয়। হাশেম মিয়া আবার যৌতুকের ধুয়া তুলেছে। বাবার কাছ থেকে টাকা আনার জন্য চলে মারপিট।
ও কখনো রুখে দাঁড়ায়।
“বাবা একবার জমি দিয়েছে। আবার কিসের টাকা?”
“তোর মতো বামন মেয়েকে কে বিয়ে করতো? চেহারার তো কোন ছিরি নেই। আবার বড় কথা। মেরে হাড় গুঁড়িয়ে ফেলবো।”
“বাকি রেখেছো কী?”
ওর গরম চোখ দেখে হাশেম মিয়া ধমাধম ঘুঁষি দেয়। কাত হয়ে পড়ে যায় ও। উঠতে পারে না। অন্যরা ঘরে নিয়ে আসে। গর্ভে সন্তান। শরীর আর ঠিক হয় না। চিকিৎসা নেই। একফোঁটা ওষুধও না। বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয় ওকে। বুড়ো বাবা ও চিকিৎসার জন্য দুধের গরু বিক্রি করে দেয়। তারপরও শেষ রক্ষা হয় না। জন্মের পরে সন্তানটি মারা যায়।
প্রথম সন্তানের মৃত্যুর কষ্ট বুকে নিয়ে কেঁদেকেটে শান্ত হয়ে আবার স্বামীর সংসারে ফিরে আসে ও। ভালমন্দ খাবার বা চিকিৎসার কোন খরচ দিতে অস্বীকার করে হাশেম মিয়া। সোজা বলে দেয়, “আমার এত গরজ পড়েনি তোমার পেছনে পয়সা নষ্ট করার।”
প্রতিবেশী আঙুরবালা বলে, “ও তো এখন গঞ্জের গোলাপির ঘরে গিয়ে জুটেছে। তোর পিছে টাকা ব্যয় করবে কেন?”
ঝর্ণার মুখে কথা সরে না। শুধু বুঝতে পারে ও আবার গর্ভবতী হয়েছে। ভয়ে ওর বুক শুকিয়ে যায়। খেতে পারে না কিছুই। বমি হয়। হাশেম মিয়া বাঁকা কন্ঠে বলে, “এইটুকু শরীর। আবার গর্ভও হয়।”
ঝর্ণা রুখে ওঠে, “আমার শরীর নিয়ে তোমার এত কথা কিসের? শরীর তো তোমার চোদ্দ রকম দেখা হয়। খবরদার আমার শরীর নিয়ে কথা বলবে না তুমি।”
“কী করবি অ্যাঁ, কী করবি?” বলেই ধমাধম কিলচড় শুরু হয়। আবার নড়ে ওঠে গর্ভের সন্তান। আবার অসুস্থতা। আবার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া। আবার একটি মৃত সন্তান প্রসব করা।
এবার ও ঠিক করে স্বামীর সংসারে আর ফিরবে না। সংসারের সাধ মিটে গেছে ওর। বাবা-মা বললেন, “থাক আর যেতে হবে না। আমরাও তো বুড়ো হয়েছি। তুই আমাদেরকে দেখবি।”
বাবা-মায়ের আশ্রয়ে এসে প্রথমে নির্বাক-নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল ঝর্ণা। লজ্জায়-ঘৃণায় কারো সামনে যেতে ইচ্ছা হতো না ওর। আস্তে আস্তে নিজের মুখোমুখি হয় নিজেই। কেন এভাবে থাকবে? কী অন্যায় ওর? ওর প্রতি যে অন্যায় করেছে তারই তো শাস্তি হওয়া উচিত। অথচ তার দিকে কেউ আঙুল তোলে না। কেউ বাঁকা কথা বলে না। লাম্পট্যের জন্য পেছনে গালমন্দ করে। সামনে কিছু বলে না। শুনেছে হাশেম মিয়া আবার বিয়ে করেছে। আহা, মেয়েটা যে কি দুঃখে থাকবে, ভাবতেই ওর কষ্ট হয়। অন্য একটি মেয়ের কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের দুঃখ ঝেড়ে ফেলে ও। ভাবে, সংসার না থাকলেই বা, কাজ করে তো সময় কাটাতে পারে, আয়-রোজগার করতে পারে, বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। এসব ভাবনা ওকে চমকিত করে, স্বস্তি দেয়। ভাবে প্রাইমারি স্কুলের পড়াটা শেষ করেছিলো, এটুকু লেখাপড়া নিয়ে একটা চাকরির চেষ্টা ও করতে পারে। মানুষ চেষ্টা করলে একটা কিছু করতে পারবেই পারবে, ঝর্ণা নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। এবং জিতে যায়। শুরু হয় ওর কাজ খোঁজা। দু’দিনের মাথায় পরিচয় হয় ভার্ডের কর্মী কোহিনূরের সঙ্গে। ওরা ফসল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কোহিনূরকে বলে, “আপা আমার একটা চাকরির খুব দরকার।”
“এখানে আসার পর থেকে আমি তোমাকে দেখছি ঝর্ণা। তোমার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তোমার ধার আছে।”
“মানুষ বামন হয় কেন আপা?”
“তোমাকে তা তো আমি বোঝাতে পারব না ঝর্ণা। তুমি বুঝতেও পারবে না।”
“আমাকে বলেন আপা। আমি না বুঝলেও শুনব।”
“আমি ডাক্তারদের কাছে শুনেছি গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি থেকে মানুষ বামন হয়। ঠিক মতো বেড়ে উঠতে পারে না। মেয়েদের রিপ্রডাকটিভ হরমোন নরমাল থাকে। তবে নরমাল ডেলিভারি হতে নানা ঝামেলা হয়। অনেক সময় মা-বাচ্চা দুজনেই মারা যায়। বুঝলে?”
“না, বুঝি নাই। আমার বোঝার দরকার নাই। আপনার কাছ থেকে যা শুনলাম তা আমি মনে রাখতে পারব।”
হাসতে হাসতে বলে, “গ্রোথ হরমন ডেফিসিয়েন্সি। আমি আর একদিন আপনার কাছে এইসব শিখব। আমার জন্মের জন্য আমি দায়ী না। তাহলে সবাই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে কেন?”
কোহিনূর বলে, “তোমার কাজ নিয়ে তুমি এগিয়ে যাবে। জন্মের জন্য গর্ব করবে। আমরা তোমার পাশে থাকব।”
হা-হা হাসিতে নিজেকে মাতিয়ে তোলে ঝর্ণা। হাসতে হাসতে বলে, “আমি ওই পাহাড়ের মাথায় উঠে সবাইকে বলব, দেখ আমাকে। আমি বামন না। পাহাড় সমান উঁচু।”
কোহিনূর বিস্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে, ও এক মেধাবী মেয়ে। ওর বড় আকারের মাথাটা শূণ্য না। ওটা মেধায় ভরা মাথা। ও অনেকদূর যেতে পারবে।
কোহিনূরের দুহাত ধরে ঝর্ণা বলে, “আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করেন আপা।”
“চলো তোমাকে একটা অফিসে নিয়ে যাই। দেখি চেষ্টা করে ওদের গ্রাম-সেবাকর্মীর পদে তোমাকে ঢোকানো যায় কিনা।”
ঝর্ণার আনন্দ ধরে না। খুশিতে বাগ্-বাগ্ হয়ে বাড়িতে এসে মাকে বলে, “দেখো এবার আমার একটা চাকরি হবে।”
সত্যি মা! আল্লাহ যেন তোর জীবনে সুদিন আনে।
নির্দিষ্ট দিনে কোহিনূরের সঙ্গে ও অফিসে যায়। যার সঙ্গে দেখা করে সে তো ওকে দেখে আঁতকে ওঠে। বলে, “এরকম একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে সেবাকর্মী হিসেবে চাকরি দেয়া যায় নাকি? গ্রামের মানুষ ওকে গ্রহণ করবে? যাকে খুশি তাকে চাকরির জন্য নিয়ে আসা কি আপনাদের উচিত?”
মুখের ওপর এমন কথায় কোহিনূর নিজে খুব বিব্রত হয়। ঝর্ণার তো কেঁদে ফেলার অবস্থা। ও হতাশ হয়ে যায়। গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে ওড়নায় চোখ মোছে। কোহিনূর বলে, “কেঁদো না ঝর্ণা। আমি তোমাকে অন্য কাজ দেবো।”
“কী কাজ আপা?”
“চাষবাসের কাজ।”
“হ্যাঁ, আমি চাষবাসের কাজ করবো। ছোটবেলায় আমি বাবার সঙ্গে ক্ষেতে যেতাম। চাষবাসের কাজ আমার খুবই ভালো লাগে। যখন বীজ থেকে চারাটা গজায়।”
“বুঝেছি বুঝেছি। তোমাকে দিয়েই হবে। তুমি মাটি আর শস্যের নারী। আমি তো এমন মানুষ চাই আমার ফসল প্রকল্প সংগঠনে। আমরা সহযোগিতা দেবো। নিজরে হাতে ফসল ফলিয়ে ভরে দেবে নিজের জমি।”
কোহিনূরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ঝর্ণা। বলে, “এমন কাজই আমি করতে চাই। স্বাধীনভাবে কাজ করবো।”
“এই গ্রামে চব্বিশ জন নারী আমার সংগঠনে সদস্য হয়েছে। তোমাকে দিয়ে আমার সদস্য সংখ্যা পূর্ণ হবে।”
“আপা।” দ্বিধায় পড়ে ঝর্ণা।
“কী বলবে বলো?”
“আপনার সদস্যরা আমাকে হেয় করে দেখবে না তো?”
“কেন?” কোহিনূর বিস্ময় প্রকাশ করে।
“এই যে আমি একটা…”
“বুঝেছি, চুপ। আমরা মানুষকে কাজ দিয়ে বিচার করি। মানুষটি দেখতে কেমন এটা আমরা ভাবি না। বুঝলে? ভালো কাজ করবে মানুষের মতো দাঁড়াবে।”
ঝর্ণা মাথা নেড়ে বলে, “বুঝেছি আপনার কথা। দেখবেন আমি সবাইকে জয় করতে পারবো।”
শুরু হয় ঝর্ণার নতুন জীবন।
প্রথম দিনের সভায় দুরুদুরু বুকে হাজির হয়। না জানি অন্যরা ওকে কী বলে। কেউ হয়তো বলবে, এমন একটা ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে ও কী করবে? চেহারাও তো এই। কথা বলা যাবে কী ওর সঙ্গে? কিন্তু ও আবাক হয়ে দেখে তেমন কিছুই ঘটলো না। সবাই ওকে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছ ঝর্ণা? আমরা খুব খুশি হয়েছি যে তুমি আমাদের সংগঠনের সদস্য হয়েছো।”
“দোয়া করবেন আমাকে।” ও লাজুক ভঙ্গিতে বিনয় প্রকাশ করে। সংগঠনে ওর যোগদান উপলক্ষে কোহিনূর সবাইকে চা-মিষ্টি খাওয়ায়। একজন ডালপুরী ভেজে নিয়ে এসেছিল সেগুলোও খাওয়া হয়। বেশ আনন্দে সময় কেটে যায়। মনোযোগ দিয়ে ও সংগঠনের কাজ করে। সময় ধরে সভায় হাজির হয়। প্রকল্প থেকে পাওয়া সবজি বীজ ওর জমিতে লাগায়। বেশ ভালো সবজি হয়। বিক্রি করে ওর লাভ হয় ছয় হাজার টাকা। বাবার হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলে, “আব্বা আমার রোজগার।” আনন্দে ওর বাবা কেঁদে ফেলে। গামছায় চোখ মুছে বলে, “বেঁচে থাক মা।”
সমিতির সবাই ওর কাজে খুশি। ওকে সভাপতি বানিয়ে দেয়। বলে, “তুমি আমাদের পরিচালনা করো।”
দিন গড়ায়। ওর দিনগুলো পাহাড় সমান উঁচু হতে থাকে। সেই পাহাড়ের মাথায় ঝর্ণার স্বপ্নের কুয়াশা ভর করে। সংগঠনের সবার সহযোগিতায় ওর ভেতরে আত্মবিশ্বাস প্রবল হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে পুকুরে গলা ডুবিয়ে গোসল করার সময় চিৎকার করে নিজেকেই বলে, “পারি, আমি পারি। আমি আরও পারবো।”
এসব কথা কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয় ঝর্ণার। মনে পড়ে নিজের মার খাওয়া জীবনের কথা। লোকটা নাকি পাঁচটা বিয়ে করেছে। কোন মেয়ে ওর সংসারে থাকে না। ঠিকই আছে, এমনই হওয়া উচিত, সময়-সুযোগ পেলে আমি একটা লাত্থি দিয়ে আসবো ওকে। হারামজাদা হাশেম মিয়া। দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ও।
কিছুদিন পর বাবার হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দেয়। বলে, “বাবা জমি কেনেন। আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য আপনি জমি নষ্ট করেছিলেন।”
“আমি তো তোর ভালো দেখতে চেয়েছিলাম মা।”
“জমি দিয়ে লোক কিনে মেয়েকে সুখী করা যায় না আব্বা।”
কথাটা শুনে ওর বাবা লজ্জা পায়। ও বাবার হাত ধরে বলে, “আমাদের অনেক হয়েছে। আমি আয় করতে শিখেছি। চলেন আমরা ওই দূর পাহাড়ের কাছে ঘুরে আসি।”
“বলিস কি মা রে?”
“ওই পাহাড়ের উপর আমি উঠব আব্বা।”
হারেছ মিয়া মেয়ের মাথায় হাত রাখে। কথা বলতে পারে না। ঝর্ণা বাবার হাত ধরে বলে, “আপনি আর কোনদিন মেয়ের বিয়ের জন্য জমি দিয়ে লোক কিনবেন না।”
মাটিতে বসে পড়ে মেয়েটাকে বুকে টেনে দূর পাহাড়ের দিকে তাকায় হারেছ মিয়া।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন