মেহেদী উল্লাহ
এক পুরুষের পুরা জীবন গিয়ে, তার পরের পুরুষের অর্ধেক জীবনে দান খয়রাতের সঞ্চিত টাকায় তৈরি পলাশপুর শাহী জামে মসজিদের বারান্দার এককোণের শয়ন কক্ষে শুয়ে ইমাম শাহজাহান মৌলভী সাব আসরের ওয়াক্তের আগে আগে দেখেছিলেন খোয়াব খানা। যদি এ খোয়াব না হইবার, তো দূরের অন্য কোনও মসজিদের আগে আগে আসরের আজান পড়ার সুরে বেঘোরে ঘুম থেকে জাগা আধো ঘুম আধো জাগরণ অংশের একটা চিন্তাও হতে পারে। চিন্তা ঠিক বলা না গেলেও খায়েশ ধরে তা খোয়াবের ঘাড়ে চাপিয়ে যে কারও অবচেতনেই ধরে রাখা যেতে পারে। মৌলভী সাব খোয়াব দেখলেন, না খায়েশ করলেন, ‘গেরামের কাউরে আর যত্রতত্র মুততে দিবেন না, তারপরে আবার লুঙ্গি হাঁটু থেকে ঝরে ঝরে পড়ে, এ কবিরা গুনাহ। মানুষ মুতবে মূত্রাখোলায় সুন্দর করে বসি, সে কিনা মুতে যেহানে সেয়ানে, মুতি পানি পানি লয় না, ঢিলা-কুলুবের বালাই নাই। হইলো এইটা কিছু! তাই তিনি বাই মুখ থেকে দুর্গন্ধওলা নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে, আর দুরুদ পড়নের আগে ডান হাতখানার উল্টো পিঠ মুখের কাছে ঝোলানোর সময় চিন্তনে জর্জরিত করে নিজেকে, ‘পুরুষ মানুষরে এইবার তিনি মূত্রাখোলায় মুতাইয়া ছাড়বেনই ছাড়বেন।’
তার চিন্তা-ভাবনায় আরও যুক্ত করলেন, পনের বছরের ইমামী জীবনে গেরামের মানুষরে খালি আল্লাহ-রসূলের নিয়ম নিষ্ঠা পালনে মন্ত্রণা দিয়েছেন। এইবার থেকে নিজের জন্য অন্তত, একবার হইলেও নিজের একখানা হুকুমত চালু করবেন। গ্রামের হগলে মেনে চললে, তার নিজের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবেন, শরিয়তের পাশাপাশি একখানা শাহজাহানি আইন পলাশপুরে জায়েজ আছে।
হুজুর ঘুম ছেড়ে আসরের প্রস্তুতির জন্য অযু করার জন্য মসজিদের পুবপাশের পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখলেন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক গিয়াসউদ্দিন উত্তর-পশ্চিম কোণে মুখ করে একখানা ঝোপের আধাআধি পর্যায়ে মুততে লাগছে। মৌলভী সাবের একটু আগে স্বপন কি খায়েশ খানা তাকে টেনে-হিঁচড়ে পুকুরের পাড়ে গিয়াসউদ্দিনের পিছাপিছি নিয়ে ছাড়ল। মৌলভী গিয়াসের মুতের শব্দ শ্রবণপূর্বক দেখলেন, তার মুতের বেগ একটা বেজিকে ঝোপে প্রস্থানে বাধ্য করলো। বেজি এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে গমনপূর্বক একটু ধলা জায়গা অতিক্রমণের সময় তাকে লেজগুটানো অবস্থায় একটা বিড়ালের মতো গুটোগুটো চারপায়ে মনে হলো।
মৌলভীর পায়ের আওয়াজে গিয়াসউদ্দিন সজাগ হয়ে ঘাড় পিছন করতেই ইমাম সাব বললেন, ‘গিয়াস মিয়া, মুতন শেষ করি ঘাটে আসো, তুমার লগে কথা আচে।’
গিয়াসউদ্দিন ভড়কে গিয়ে ভাবল, কথা আছে। কিন্তু হুজুর পিছন আসল কেন? মসজিদে গেলে, পুকুরের ঘাটে গেল, অথবা অন্য কোথাও দেখা হলে তো বলতে পারত, কী কথা তার সাথে?
যাই হোক, ত্যাগপূর্বক হুজুরের পিছন পিছন পুকুরের ঘাটে এসে দাঁড়ালো গিয়াসউদ্দিন।
হুজুর বললেন, ‘মুতনের কি আর জায়গা পাও না মিয়া?’
গিয়াসউদ্দিন বললো, ‘হুজুর এতো মসজিদ থেকে দূরে, কেবলা থেকেও অন্য মুই।’
‘হোক। কিন্তু খোলা ময়দান তো! এইভাবে তুমরা গেরামের মানুষ যেহান-সেহানে মুততে পার না।’
গিয়াসউদ্দিন মাথা নিচের দিকে দিয়ে তাকিয়ে বললো, ‘জি হুজুর।’
মৌলভী সাব আবার বললেন, ‘মুইতা ঢিলা-কুলুব লও তো?’
‘না হুজুর, পানি।’
‘নাহ! ধ্যাত. তুমাগো নিয়া আর পারলাম না। এই শুক্রবারে যা কওনের কমু। জুম্মার নমাজে আসবা তো?’
গিয়াসউদ্দিন কিছু বলতে চায়।
সামান্য চুপ থেকে একটু পর আবার বলল, ‘হুজুর বিয়াদবি নিয়েন না, আমার বাবা আলফাজউদ্দিন, তার বাবা আফাজউদ্দিন, এইভাবেই তো সবাই মুততেছি, মুইতা আসতেছি।’
হুজুর এবার সামান্য চটলেন, ‘ওই মিয়া মুখে মুখে কতা কও কেন? বাড়িত যাইয়া তুমার বিবি সাবরে জিগাইয়ো তো, হেই কেন এই তোমাগো মতন যেহানে-সেহানে মুতে না? যাও এখন যাও, বললাম তো, জুম্মার নমাজে বলব।’
গিয়াসের মাথায় ধরে না। আগে কখনও ভাবে নাই। হুজুর বলার পর ব্যাপারটা মাথায় খেলে। আসলে তো। আমি মুতি, যহন খুশি তহন, যেহানে ইচ্ছা হেয়ানে, হেতি তো মুতে না।
রাত্রিকালে কথা নাই বার্তা নাই, গিয়াসউদ্দিন হঠাৎ মুখ খুলে বিবির কাছে জানতে চায়, ‘আইচ্ছা, পুরুষ মানুষ যেহানে সেহানে মুতে, মাইয়া মানুষ মুতে না ক্যান্!’
কথাটা শোনার পরপর বিবি সাহেবার বুঝতে কষ্ট হলো। সে চোখ কপালের দিকে সরিয়ে বলল, ‘কী কইলেন আপনে?’
‘না ওই বিকাল থেইকা ভাবতেছি, মাইয়া মানুষ মুতে না ক্যান?’
‘আপনের কি মাথা খারাপ হইচে!’
‘না, কী কও মাথা খারাপ হইবো ক্যা।’
‘নাতো কী! এরুম চিন্তা কেউ করে!’
‘তুমি এত কতা কও ক্যান! উত্তুর থাকলে দেও, নাইলে নাই।’
বিবি সাহেবার লগে গিয়াসউদ্দিন বিাবাহিত জীবনের কেনো একদিনও এমন হালকা আলাপ পাড়ে নাই। তাই চান্স পাইয়া আজ বিবি একটু পরেই স্বামীকে বলল, ‘অন্য মাইয়া মাইষের কতা জানি না, আমি তো মুতি না তুমার ভয়ে। সবাই তুমারে বলবো, তুমার বউরে দেখছি…। ছি! আমার শরম করে।’
‘আইচ্ছা। এই চিন্তা লইয়া আমি ঘুরতাছি ক্যান, ও ইমাম সাব…।’
তারপরে গিয়াসউদ্দিন হঠাৎ দৃশ্য পাল্টে বিবি সাহেবাকে ধমক মেরে বলল, ‘রাত্রি অনেক হইচে, ঘুমাইয়া পড়ো।’
‘আরে কতা ত তুললেন আপনে, জিগাইলেনতো আপনে’—এই প্রতি উত্তর মুখে না প্রকাশ করে, দিলের মধ্যে রেখে অন্য পাশ ফিরে চোখে গিট্টা বাঁধল বিবি।
শুক্রবারে ইমাম সাব জুমার নমাজের খুতবায় উল্লেখ করলেন তার মনোবাসনা।
পলাশপুরবাসীকে তিনি নির্দেশ দিলেন, আর কোনও পুরুষ খোলা জায়গায় যেখানে সেখানে মুততে পারবো না। যদি মুতে কঠিন শাস্তি তাকে পেতে হবে। পুরুষ মুতবে মূত্রাখোলায়। হুজুর মাইকে ঘোষণা দিলেন, ‘তোমরা রাস্তায় রাস্তায় মূত্রাখোলা গড়ে তোল। বাঁশ, চটের বস্তা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ো। আজ বিকাল থেকেই। ঈমানদার ভাইরা অবশ্যই শয়তানের মোকাবেলা করবে, ইনশাল্লাহ।’
শুধু মূত্রাখোলা করলেই চলবে না। শৌচকার্যের প্রধান সরঞ্জাম ঢিলা-কুলুবও বানানো শুরু করে দিতে হবে।
তিনি বললেন, ‘আপনারা খাল থেকে নতুন মাটি তুলে আনুন। প্রতি ঘরের উঠানে গোল গোল ঢিলা বানিয়ে রোদে শুকিয়ে নিন। এমন কি তিনি খোরাকির মতো বর্ষাকলেরটাও অগ্রিম বানিয়ে রাখার আদেশ দিলেন গ্রামের সর্বস্তরের জনগনকে। আরো বললেন, ‘যেখানে-সেখানে মুতা নাফাকি কাজ, গুনাহর কাজ। আজ থেকে একটা পুরুষ মানুষও খোলা জায়গায় মুতবে না।’
তিনি মুসল্লিদের জানিয়ে রাখলেন, আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে হবে সবাইকে। মূত্রাখোলা তৈরির কাজ, ঢিলা বাননোর কাজ। রাস্তার প্রতি চল্লিশ কদম অন্তর অন্তর মূত্রাখোলা বানাতে হবে। যত বাঁশ লাগে মানুষ দেবে, ঘরে না থাকলে নিজেদের ঝাড় থেকে দেবে। আগামী শুক্রবারে জুমার নমাজের পরে তিনি সবকার্য পরিদর্শন করবেন।
গ্রামের দুই একজন যারা নূন্যতম লেখাপড়া করেছে, বা যাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের মধ্যে শ্রবণ ইন্দ্রিয় এখনও পরিষ্কার কাজ করছে, যাদের দিল অনেক খোলা-সচল-সক্রিয় তাদের মধ্য থেকেও এক দুইজন হুজুরের খুতবায় কীসের সঙ্গে যেন শ্রাব্যধ্বনির মিল খুঁজে পেল, এর আগেও কোথায় যেন শুনেছে, অথচ তাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার দরুণ স্মরণ করে উঠবার আগেই সেদিনের জন্য জুমার নমাজ শেষ হয়ে যায়। তারা অবশ্য একটু চেষ্টা করলেই ধরতে পারতো সুরটা, কিন্তু মোনাজাতে অধিক অবেগী ও মনযোগী হয়ে মহান আল্লাহপাকের কাছে মাফ চাইতে হয় বিধায় চ্যালেঞ্জটা কেউ নিতে চাইলো না। সুযোগও ছিল না।
সপ্তাহখানেক বাদে সবকার্য সমাধা হওয়ার পরে শাহজানি আইন মোতাবেক পালাশপুরবাসী যেখানে সেখানে না মুতে নির্ধারিত মূত্রাখোলায় মুতা আরম্ভ করলো। প্রতিটি মূত্রাখোলার পাশে অবার ঢিলা-কুলুব সংরক্ষণের স্থান থাকলো। খায়েশ পূরণ হওয়ার পর শাহজাহান মৌলভী সাব এবার তৎপর তার চক্ষুর গোচরে-অগোচরে কেউ যাতে আইন লঙ্ঘন না করতে পারে। পাঁচবেলা নামাজ, তিনবেলা খাবার আর একবেলা ঘুম বাদে তিনি রাস্তায় রাস্তায় কেবল পায়চারী করে পাহারা দেন সবাই মূত্রাখোলায় মুততেছে তো!
তিনি কী এক অপরূপ স্বস্তি পেলেন! আইন মানছে মানুষ। তা তো সকলের মঙ্গলেরই জন্য, নাকি?
একদিন রাস্তায় ইমাম সাবের সঙ্গে দেখা গিয়াসউদ্দিনের। হুজুর জানতে চাইলেন, ‘গিয়াস মিয়া মুত ঠিক মতো হচ্ছে তো?’
‘জি হুজুর, হচ্ছে, ভালা হচ্ছে, এই যে বিবি কাগজ প্যাঁচিয়ে জামার পকেটে ভরে ঢিলা-কুলুব দিয়া দিচে, প্রতিদিন ঘর ছাড়ার আগে বলে, বাইরের কুলুব ক্যান, এই কুলুবে না কি সে যত্ন মেখে দিচে নিজ হস্তে।’
‘আল হামদুলিল্লাহ, ঢিলা যারই হোক, মূত্রাখোলায় গেলেই হোলো। তোমার বিবির মতো যারা বাড়িতে কষ্ট করে ঢিলা বানাইতেছে সবাইরে আল্লাহ জান্নাতী করুক। আমিন। তুমার বিবিরে আমার পক্ষ থেইকা সালাম দিবা।’
প্রতিটি গ্রামেই থাকে না, একদল দুষ্ট ছোকরার দল, পলাশপুরেও আছে। সেই ছোকরার দলকে একদিন কাছে টেনে ইমাম সাব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। তাদের কাজ আগেও ছিল গ্রামে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো, এখনও তাই। তবে শুধু নিজেদের চক্ষুদ্বয়কে সজাগ রাখতে হবে। হুজুর লজেন্সের লোভ দেখিয়ে তাদের বললেন, ‘তোমরা পাহারা দিবা, ঘুরতে ঘুরতে পাহারা দিবা, কেউ যেন মূত্রাখোলার বাইরে না মুততে পারে, সেই খেয়াল রাখবা। এই আকাম করলেই আমারে সাতসাত খবর দিবা। প্রতিদিনি তুমগো রিযিকে লজেন্স বরাদ্দ আছে। সামনের জনকে ইশারা করলেন কাছে আসতে। আসতেই তিনি বললেন, ‘হাত খোল্, আমার সম্মুখে প্রসারিত করে ধর।’ বালক ধরতেই তিনি চট করে তার হাতে একটা লজেন্স গুঁজে দিলেন। এভাবে সিরিয়ালি সবাইকে।
ছোকরার দল লজেন্সের লোভে পাহারা দিতে আরম্ভ করলো, সেই সঙ্গে আরও বাড়তি দায়িত্ব, কোথায়, কোন রাস্তায় মূত্রাখোলার বাঁশ উল্টে চট চটকে গেছে সেই সব খবরও হুজুরকে দেওয়া। হুজুর লোক পাঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা ঠিক করে দেন। শাহজাহানি আইন কায়েমের বদৌলতে শাহজাহান মৌলভী সাব অন্য রকম শান্তি পান দিলে নগদ নগদ। এর আগে এমন শান্তি কখনও অনুভূত হয়নি। কত আইন-কানুন! উঠতে-বসতে কত আইন পালনের দিশা দিয়ে আসছিলেন পলাশপুর বাসীকে। কোরান-সুন্নাহ তালাশ করে করে গ্রামবাসীকে খাঁটি মুমিন বানানোর হেদায়াত। আহা! এর আগে দিল ভরে এত স্বস্তি একসঙ্গে আসেনি।
মসজিদের একটু দূরেই ইমাম সাবের বাড়ি, একলা নতুন বাড়ি। বাড়িতে কোনও পুরুষ মানুষ নাই, তারপরেও হুজুর মাঝে মাঝেই যান, দুই এক দিন পরপর, সেজন্য গ্রামের কোনও কোনও বাড়ি থেকে ঢিলা-কুলুব উপহার যায় তার বাড়িতে। হুজুরের কাজ তো দিবাভাগের অধিকাংশই মসজিদে। তাই বিবি একা খাল থেকে মাটি বয়ে নিয়ে আসা, তারপর আবার গোল গোল করে ঢিলা বানানো, এইসব বিবির একা সইবো না। তাই অধিক সোয়াব এবং খানিক পর উপকারের নিমিত্তে কেউ কেউ ওড়া ওড়া রেডিমেট ঢিলা পাঠায় তার বাড়িতে। এছাড়া অন্যের বউয়ের হিসেব তো আর তার নয়। নিজের বিবির আখেরাতের হিসেব বড়জোড় সে কষতে সহায়তা করতে পারে। তাই বেআব্রু হওয়া চলবে না বিবি সাহেবার।
ছয়সাত মাস চলে যাওয়ার পর এখন গ্রামের সব পুরুষ মানুষ মূত্রাখোলা ব্যবহারে পুরোপুরি অভ্যস্ত, এমনকি গ্রামের ওপর দিয়ে অন্যগ্রামের কোনও পুরুষ মানুষ যাবার পথে মুত লাগলে, মূত্রাখোলায় গিয়ে মুতে। তেমনি এক দুপুরে শহর ফেরত এক যুবক, জিন্সপ্যান্ট আর শার্ট পরা, সে গ্রামের এক রাস্তার পাশে আধাআধি ঝোপের ভেতর দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন খুলে প্রস্রাব শুরু করলো। তার প্রস্রাব অর্ধেক না গড়াতেই ছোকরার দলের নজরে আসে কর্মটা। তাদের দুই-একজন ঘটনাস্থলে থেকে বাকিরা হুজুরকে খবর দেয়। তখন মাত্র জোহর নমাজ শেষ, ফাঁকা ফিল্ড পেয়ে হুজুর হুড়মুড় করে ছুটে আসলো। মসজিদের পঞ্চাশ-ষাট কদমের মধ্যে হওয়ায় দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ইমামসাব দেখল, যুবক সবে প্রস্রাব শেষ করে প্যান্টের চেইন লাগাচ্ছে। হুজুর স্বয়ং তাকে ঝাপটে ধরে বললেন, ‘কোন গ্রামের মানুষরে। আশপাশে এত মূত্রাখোলা থাকতে কেন এই আকাম! হ্যাঁ আইন লঙ্ঘন, সাক্ষাত আইন লঙ্ঘন।’
গ্রামের দুই একজন মুরব্বিকে এরই মধ্যে যোগাড় করে যুবককে মসজিদের ধারে আনার হুকুম দিলেন। যুবক ঘটনা কিছুই বুঝতে না পেরে বারবার আওড়ে যাচ্ছে, ‘আরে! আমি…। কী করছি, কী করছি!’
হুজুর ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি রাস্তায় খাড়ায়া মুতছো।’
পাশ থেকে আরেকজন উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘এই গ্রামে বইসাই মূত্রাখোলার বাইরে মুতার পারমিশান নাই, আর হে কিনা খাড়াইয়া মুতছে…চোপ, কতা কবি না।’
আরেকজন যোগ করে, ‘জানোয়ার, পশু…।’ আওড়াতে আওড়াতে ধমক দিয়ে জানতে চাইলো, ‘যাইবা কুন গ্রামে?’
যুবক তার পরিচয় দিয়ে বললো, তার নাম রিয়াজ খন্দকার। হোসেনপুরে তাদের বাড়ি। তার বাবার নাম খাদেম আলী মেম্বার। এই মাত্র ঢাকা থেকে এসে নেমেছে। তাও আবার একবছর পর এসেছে।
যুবক বারবার তাকে যেতে দিতে অনুরোধ করছে।
কিন্তু হুজুর বা এরা এত সহজে ঢেঁকি গেলার মানুষ না। হুজুরে এক কতা, ‘আগে বিচার। তারপর যাওয়া। নাফরমান, বেত্তমিজ কোনহানকার, মেম্বার, চেয়ারম্যান বুঝিনা, খাড়ায়ে মুতার বিচার হইবো, তাও আবার মূতাখোলার বাইরে।’
এর মধ্যে মসজিদের সামনে লোকজন জমতে শুরু করেছে। গ্রামে মুখে মুখে ছাড়াতে থাকলো, হোসেনপুরের খাদেম অলাী মেম্বারের পো খাড়ায়ে মুতছে। ইমাম সবা হুজুর হাতে নাতে ধরছে গিয়া। যুবককে মসজিদের বারান্দার সামনে সিমেন্ট ঢালাইয়ের উপর বসিয়ে রাখা হলো। সে উঠতেই পারছে না। নড়াচড়া করলেই ধাতানী দেয় কেউ না কেউ। বলে, ‘শহরে গিয়া মিয়া এই লেহাপড়া করচো, খাড়াইয়া মুতা শিক্ষা কইরা আসচো, এমনে তো মুতে কুত্তা। তুমি কি পশু? হ্যা।’
খাদেম আলী মেম্বার ঘটনা শুনে ঘন্টাখানেক পরে নিজ গ্রাম থেকে পলাশপুর শাহী জামে মসজিদের সামনে উপস্থিত হলো। পুত্রের শোচনীয় অবস্থা দেখে বাপ ইমামসাবের কাচে ঘটনা জানতে চাইলো, যদিও এর আগে তার কানে ওঠার কথা বিষয়টা। মেম্বার হুজুরকে অনুরোধ করল, ‘হুজুর ছেলে ঢাহাতে পড়ে, গেরামের আইন-কানুন জানে না। এইবারের মতন মাফ করেন।’
‘কী কাইলেন মেম্বার! গেরামের আইন-কানুন? আসতাগফিরুল্লা। গেরামের আইন পাইলেন আমনে! আরে, এই জন্যই তো, এইজন্যই তো। আপনার পোলা খাড়াইয়া মুতবো না, কে মুতবো?’
‘হুজুর, আমার ভুল হইচে, ছেলেরে ছেড়ে দেন।’
‘ভুল তোমার পোলারও হইছে। আমি ছাড়ার কে। আইন যারা মাইনা চলে তারা কোক। মুরব্বিরা আছে, হেগোরে জিগাও।’
কেউ বিচার ছাড়া ছাড়তে রাজি না। সাজা হবে। কঠিন সাজা। জনগণ জমা হয়ে আবেদন করে হুজুর কে বললো, ‘সাজা চাই, সাজা চাই। এই বেত্তমিজের সাজা চাই।’
‘জানোয়ার কোনহানকার’, কোত্থেকে যেন ছুটে আসলো গিয়াসউদ্দিন। এসে বললো, ‘এই কি দেহো হগলে তাকাইয়া, আঁইক্কাওলা বাঁশটা কই? হালা, দুই পুরুষের অভ্যাস ত্যাগ কইরা মূত্রাখোলায় ঢুকছি, আর হালা খাড়ায়ে মুতে। হুজুর এর কঠিন বিচার অইবো। মেম্বার-টেম্বার বুঝি না, হেডি পরে। দোষ দোষই। গুনাহ তো গুনা।’
হুজুর হগলরে উত্তেজিত না হয়ে ধৈর্য ধরতে বললেন। আরো বললেন, ‘থামো সবাই। ধৈর্যশীলগো লগে আল্লা আছে।’
সবাই শান্ত হলে হুজুর জানতে চাইলেন, ‘কী বিচার হবে, আপনারা হগলে কন?’
গিয়াসউদ্দিন বললো, ‘আপনিই ফায়সালা দেন হুজুর। আপনি যেই শাস্তি দিবেন, তাই হইবো।’
মেম্বার চুপ হয়ে গেল, কোনও কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু, সে কোনওভাবেই তার ছেলের অন্যায় কিছু হয়েছে মানতে নারাজ। তবুও এখন অসহায়। এখানে থানা চলে না। চলে শাহজাহানি আইন। তারপর হগলে ক্ষেপছে।
হুজুর বললেন, ‘হুনেন মেম্বার, এইডা কারো ঢেউ টিন চুরি বা গম চুরির অপরাধ না যে আপনি চেয়ারম্যানের সামনে বসাইয়া সাজা দিবেন।’
হুজুর সবাইকে বললেন, ‘এরে এক জায়গায় খাড়া করাইয়া তারপর শরীর থেকে রক্ত বাইর না হওন পর্যন্ত ঢিলা-কুলুব ছুইড়া মারো। যাও হগলে গিয়া বাড়ি থেকে ঢিলা-কুলুব নিয়া আসো।’
আধাঘন্টা পরেই শুরু হয় ‘শয়তানকে পাথর’ নিক্ষেপপর্ব!
খাড়ায়ে মুতার অপরাধে যুবকের গায়ে গ্রামবাসী ঢিলা-কুলুব নিক্ষেপ করলো, যতক্ষণ না রক্ত বের হলো, শরীরের স্থানে স্থানে শক্ত শুকনো ঢিলার আঘাতে চামড়া দলা হয়ে ঢিলার মতো আকারে না পরিণত হলো।
এই ঘটনা বৃহস্পতিবারের, পরদিন শুক্রবারের জুমার নামাজে হুজুর ঘোষণা দিলেন, ‘গতরাতে আমি একটা খোয়াব দেখছি। শেষ রাতের খোয়াব। আমি দেখছি, এক কামেল লোক বলছে, যুবকের খাড়ায়া মুতার শাস্তি এখনও শেষ হয় নাই। যুবকের সঙ্গে এমন মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে, যে মেয়ে জন্ম থেকে এখনও পর্যন্ত মূত্রাখোলা কিংবা মায়ের আঁচলের বাইরে মুতে নাই, সে মেয়ের সঙ্গে যুবকের বিবাহ দিতে হবে।’
নাহলে অভিশাপ। সব বরবাদ। মাঠে ফসল হবে না, গৃহপালিত পশুর বিমার, অভাব, অসুখ-বিসুখ শুরু হবে। সময় মাত্র এক সপ্তাহ। ইমামসাব সবাইকে এমন পাত্রী খোঁজার আহ্বান জানিয়ে জুম্মা শেষ করলেন।
পরদিন থেকে পাত্রী প্রাপ্তির খোঁজ নিয়ে ইমামসাবের কাছে আসতে থাকে গ্রামের ময়-মুরম্বি, ছেলে-যুবা সবাই। কেউ বলে, আমার মেয়ে, কেউ বলে শালি, কেউ বলে বোন…. উপযুক্ত। কিন্তু ইমামসাব হুজুর বলেন, ‘আরে কইলেই হইলো, তোমাদের পাত্রী তো মানুষ হাইছে রাস্তা ঘাটে। ছোডকালে কখন কুনখানে বইসা মাটি ভিজাইছে তার খবর আছে? দেখলা কেমন করি, পাহারা দিয়া রাখছো নাকি?’
পরের শুক্রবার এসে উপস্থিত। ইমাম সাব নমাজের পরে সবাইকে বসতে বলেছিলেন। তিনি বললেন, ‘পাত্রী তো মিললো না। আপনারা তো কেউ খোঁজ দিতে পারলেন না। তাইলে কী হবে গ্রামের, গ্রামবাসীর। খোয়াব যদি ফলে, কী হইবো তখন সবার! যুবকের সঙ্গে আর মাত্র এক রজনী সীমার মধ্যেই এমন এক মেয়েকে বিবাহ দিতে হবে, যে মেয়ে কখনও বাইরে মুতে নাই। আপনার উত্তর দেন, কেউ তো পান নাই। চুপ থাইকেন না।’
কেউ একজন বললো, ‘হুজুর আমরা খুঁজতে বাকি রাখি নাই, কিন্তু কোথায় মিলবে এমন পাত্রী, সব মেয়েই তো ছোট থাকতে রাস্তায়-আড়ায়-পাড়ায় ছুটে-বেড়িয়ে মানুষ, কোথায় না কোথায় মুতছে, তার খবর আচে? শেষে বিবাহতেও সিদ্ধি হবে না। কবুল না হলে গ্রামে মড়ক আসবে।’
হুজুর সামান্য চুপ থেকে, খানিক অপেক্ষায় থাকলেন, সবাই তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। ত্রাণকর্তা তিনিই এখন। তারপর মুখ খুললেন হুজুর।
শান্তভাবে, থেমে থেমে বললেন, ‘আমার একটা মেয়ে আছে, শুনেছেন তো আপনারা। কেউ কখনও দেখেছেন বলে মনে হয় না। কী আর করা, গ্রামের মঙ্গল আমারও মঙ্গল। পলাশপুর আমার সোনার গ্রাম, আর এই গ্রামে কিনা ফসল হবে না, এই গ্রামে খরা হইবো, ভাবা যায়! সবাই না খেয়ে থাকতে হবে। আমি সইতে পারবো না। আপনারা যদি অমত না করেন, তবে আমার মেয়েকে আমি উৎসর্গ করলাম পলাশপুরবাসীর জন্য। আমার মেয়ে কখনও মূত্রাখোলার বাইরে মুতে নাই, ছোডবেলায় মায়ের কোলে অথবা অন্ধার কুঠুরির বিছানায় মুতছে। আপনারা বলুন, কী করবো?’
গুঞ্জন উঠলো খানিক, এক দমকা বাতাসের মতো ভারী বাতাস। সবাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অপরাধী যুবকের বাবা মেম্বারকে আগেই খবর দিয়ে মসজিদে হাজির রাখা হয়েছে। সবাই মেম্বারকে ঘিরে ধরলো। বলল একজন, ‘মেম্বার তুমার ছেলের সঙ্গে হুজুরের মেয়ের বিয়ে হলে আমরা বেঁচে যাই, মেম্বার। কী কও মেম্বর?’
হুজুর সবাইকে থামতে বললেন, তারপর হুকুমের সুরে বললেন, ‘মেম্বারের কিছুই করার নাই, আমারও কিছু করার নাই, আপনারা তো পাত্রী খুঁজলেন। পাইলেন? সব বিধান খোয়াবের। সেই খোয়াবের নির্দেশে। আইজ রাইতে আমার বাড়ি বরযাত্রী আসবে। সবার দাওয়াত। আর একটা কথা, স্ত্রীলোক সকলে অতি অবশ্যই বোরকার সাথে সাথে হিজাব-নিকাব পরিধান করে আসবে। যাও মেম্বার, তুমার পোলারে সাজাইয়া-গোজাইয়া লও। দিন ছোড। সময় বেশি বাকি নাই।’
ধীরে ধীরে মসজিদের গেটে রাখা স্যাণ্ডেল আর জুতার ভীড় কমতে শুরু করল। পলাশপুরবাসী সেই জুতা-স্যাণ্ডেল পরে কোথায় যাচ্ছে!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন