অদিতি ভট্টাচার্য
“ওটার দাম কত? না-না ওটা নয়, ওর পাশেরটা, হ্যাঁ-হ্যাঁ ওটা…”
“আড়াইশো।”
“আড়াইশো! দাম বড় বাড়িয়ে বলছেন আপনারা! এটার আর ওটার কাজের কী এমন পার্থক্য যে একেবারে একশো টাকা বেশি চাইছেন! এটার দাম তো দেড়শো বললেন!”
দোকানদার মধুছন্দাকে দুটো হাত ব্যাগের কাজের পার্থক্য বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল আর সুব্রত প্রমাদ গুণলেন। এই দরদাম পর্ব কতক্ষণ স্থায়ী হবে কে জানে! পছন্দ যখন হয়েছে তখন ওটাই যে না কিনে ছাড়বেন না মধুছন্দা তা বিলক্ষণ জানেন সুব্রত।
এসব মেলা-টেলায় আসার ইচ্ছে যে প্রবলভাবে পোষণ করেন সুব্রত তা নয়, জিনিস কেনাকাটা করার ইচ্ছে তো আরওই নেই। কিন্তু তাও আসতে হয়, কারণ গৃহিণীর সেই রকমই ইচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে সুব্রতর ভূমিকা নীরবে মধুছন্দাকে অনুসরণ করা এবং ক্রীত জিনিসপত্রের ভার বহন করা। কোনও দোকানে একবার মধুছন্দা ঢুকলে অবশ্য তাঁর বেশ অনেকটা সময় লেগে যায়, কোনও কিছুই চটপট পছন্দ করা তাঁর ধাতে নেই, সেই অবসরে দোকানের কাছাকাছি একটা চেয়ার বা টুল পেলে সুব্রত বসে খানিক জিরিয়ে নেন আর চারধারে চোখ মেলে চলমান জীবনের ছবি দেখেন। কেউ কিনছে, কেউ শুধুই ঘুরছে, কিনছে না, কেউ বা উচ্চৈঃস্বরে দরদাম করছে, কেউ খাওয়ায় ব্যস্ত, দলবেঁধে গল্প করতে-করতে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে, তাদের কলহাস্যের আওয়াজ দূর থেকেও কানে আসছে, সুসজ্জিত দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার হিড়িক, রাজস্থানী ঝুটো গয়নার দোকানে উপছে পড়া ভিড় – এ সবই দেখেন সুব্রত। আসতে যখন হয়ই, তখন দেখেন দু’চোখ ভরে। এমন কিছু নতুন দৃশ্য নয়, প্রতি মেলাতেই কম বেশি দেখা যায়, হয়তো বা পসরার ধরণ ভিন্ন-ভিন্ন হয়, তবুও দেখেন সুব্রত, দেখতে ভালো লাগে তাঁর, দেখতে ভালোবাসেন তিনি।
আজ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনও চেয়ার-টেয়ার দেখতে পেলেন না, বাধ্য হয়েই হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মিনিট দশেক পরেই মধ্যেই মধুছন্দা বিজয়ীর গর্বিত পদক্ষেপে বাইরে এলেন, পছন্দের ব্যাগ আড়াইশো নয়, দুশোতেই কিনে ফেলেছেন।
“ওই দোকানটাতে চলো দেখি, মনে হচ্ছে কুশন কভার আছে,” মধুছন্দা বললেন।
দোকানে জিনিসপত্র সাজিয়ে নিয়ে বসেছে একজন পুরুষ এবং মহিলা, মনে হয় দম্পতি। সুব্রত এসবের বিশেষ কিছুই বোঝেন না, তাও মনে হল এদের জিনিসগুলো বেশ সুন্দর, মধুছন্দার পছন্দ হবে, হয়তো তাড়াতাড়িই হবে, খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করেই, প্রতিটা জিনিসই বেশ নজরকাড়া, কী মনে করে সুব্রতও মধুছন্দার পেছন-পেছন দোকানে ঢুকলেন।
“আসুন, কী দেখাব বলুন,” লোকটি হাসিমুখে বলল, তার স্ত্রী তখন অন্য কয়েকজন ক্রেতাকে জিনিসপত্র দেখাতে ব্যস্ত।
কুশন কভার দেখানোর ফাঁকে লোকটি মাঝে-মাঝেই আড়চোখে সুব্রতকে দেখছে, সুব্রতরও যেন মনে হচ্ছে একে কোথাও দেখেছেন, কিন্তু কোথায়, কখন সে আর মনে করতে পারছেন না। এরকমভাবে তাকিয়ে থাকা একেবারেই শোভন নয়, সুব্রত তাই দোকানের বাইরে চলে এলেন। কোথায় দেখেছেন একে?
সন্ধ্যে হচ্ছে, মেলার মাঠে আলো জ্বলে উঠেছে, ভিড়ও বাড়ছে। সুব্রত শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে, কোথায় দেখেছেন একে?
“কী হল, কী দেখছ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে? ওরকম হট করে দোকান থেকে বেরিয়েই বা এলে কেন?” মধুছন্দা কেনাকাটা শেষ করে কখন যেন বেরিয়ে এসেছেন দোকান থেকে।
সম্বিত ফিরে সুব্রত বললেন, “এবার এক কাপ চা খেলে হয় না? একটু বসাও হবে?”
“তাই চলো। এই দোকানটা খুব ভালো, বেশ মনোমতো জিনিস পেয়ে গেলাম, বুঝলে। আর ভাবছি বেশি ঘুরব না, বাড়ি চলে যাব,” মধুছন্দা বললেন।
সুব্রত মনে-মনে বললেন, “আজ কোনদিকে সূর্য উঠেছিল কে জানে!” মুখে বললেন, “বেশ চলো, একটু চা খেয়ে নিই।”
সামনেই চা, কফির স্টল, বলতে গেলে এই দোকানটার মুখোমুখি, সেখানেই গেলেন দুজনে।
“এরা নাকি অনেক দোকানে জিনিস সাপ্লাই দেয়, গুজরাট থেকেই এসেছে। আমাকে কার্ড দিয়েছে, ফোন করে বললে বাড়িতে দিয়ে আসবে। মাঝে মাঝেই নাকি আসে এদিকে,” মধুছন্দা বলেই যাচ্ছেন।
“গুজরাট থেকে এসেছে? কী নাম?” সুব্রত জিজ্ঞেস করলেন, “বাংলা তো বেশ বলে দেখলাম।”
“বলবে না কেন? বাঙালিই তো! অনেক বছর আছে নাকি গুজরাটে। নাম বিশ্বনাথ, পদবীটা কী যেন বেশ বলল, ভুলে গেছি।”
“আরে মধুছন্দা যে, তুমিও এসেছ!” পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে মধুছন্দা, সুব্রত দুজনেই ঘুরে তাকালেন, মধুছন্দার বন্ধুস্থানীয়া দুই ভদ্রমহিলা।
এ টেবিলটায় তিনটে চেয়ার, সুব্রত উঠে দাঁড়ালেন, “আপনারা বসুন, আমি অন্য টেবিলে যাচ্ছি।”
মৃদু আপত্তি উঠল, “কোথায় যাবেন, টেবিল খালি আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”
সুব্রত পাত্তা দিলেন না, হেসে বললেন, “এক কাপ চাই তো, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েও দিব্যি খাওয়া যায়!”
বিশ্বনাথ নাম, গুজরাটে অনেক দিন আছে…. ভাবতে-ভাবতেই চায়ে চুমুক দিলেন সুব্রত। সামনেই বিশ্বনাথের দোকান, বেশ ভিড় এখন, ক্রেতাদের আড়ালে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বনাথ… এ সেই বিশুয়া নয় তো? সেই কচ্ছের রণের বিশুয়া? রোগা, পাতলা, শ্যামলা, দুঃখী-দুঃখী মুখের সেই ছেলেটা? বড়ো জোর উনিশ কুড়ি বছর বয়স? অবশ্য তাকে দেখেছিলেন সুব্রত আজ থেকে কুড়ি একুশ বছর আগে। হ্যাঁ এ সেই, সেই বিশুয়াই এই বিশ্বনাথ, যে সুদূর গুজরাট থেকে পণ্যসম্ভার নিয়ে এসেছে এই হস্তশিল্প মেলায়। এক লহমায় সুব্রত ফিরে গেলেন পেছনে, সেই কুড়ি একুশ বছর আগে। তাঁর চোখের সামনের মেলার মাঠ নিমেষে বদলে গেল রণের রুক্ষ্ম জমিতে।
তখনও এত কচ্ছের রণে যাওয়ার চল হয়নি। গুজরাট বেড়াতে গেলে লোকে সাধারণত আমেদাবাদ, সুরাটের মতো বড় কয়েকটা শহরে যেত আর সোমনাথ, দ্বারকায় গিয়ে মন্দির দর্শন করে পুণ্য অর্জন করত। সুব্রত তাঁর ভ্রমণ সূচীতে কচ্ছের রণও রেখেছিলেন, লিটল রণ, গ্রেট রণ দুটোই। কচ্ছের রণ দেখার আগ্রহ তাঁর ছোটবেলা থেকেই।
তখন এত হোটেল, রিসর্টও গড়ে ওঠেনি। ছিল, অল্প কিছু। লিটল রণে যেখানে ছিলেন সেটা বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা একটা রিসর্ট। সুব্রতর এক সহকর্মীর জেঠুতুতো দাদা কর্মসূত্রে থাকতেন ভুজে, তিনিই এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সুব্রতর খুব ভালো লেগেছিল রিসর্টটা, লাগোয়া অনেকটা চাষের জমি। রিসর্টে রান্নার জন্যে প্রয়োজনীয় তরিতরকারির সিংহভাগই সেখানে ফলে। শীতকাল ছিল তখন, ছেলেমেয়েদের বড়দিনের ছুটি চলছিল, রিসর্টের প্রায় সবক’টা ঘরই ভর্তি ছিল। কাজ করা ছেলের দল একবার এ ঘর একবার ও ঘর দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াত। তাদের মধ্যেই বিশুয়ার দিকে নজর পড়েছিল সুব্রতর। কারণ আছে। জল চেয়েছিলেন, জল নিয়ে ঘরে এসেছিল সে, তারপর পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “আর জল দিব কি?”
সুব্রত চমকে গেছিলেন, এখানে বাঙালি ছেলে কাজ করে!
আলাপ করতে ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু পারেননি, তার তলব এল, সেও দৌড়ল। সে সুযোগ হয়েছিল কিছুক্ষণ পরে। সুব্রতর ছেলেমেয়ে দু’জন খুব ফুর্তিতে ছিল। তারা আজন্ম কলকাতার বাসিন্দা, এরকম উন্মুক্ত চাষের ক্ষেত তারা দূর থেকে দেখেছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে এরকম থাকার সুযোগ কখনও পায়নি, এরকম ছোটাছুটি করার জায়গা বড় একটা পায় না তারা, তাই তাদের ঘরে আটকে রাখা রীতিমতো সমস্যা হচ্ছিল। বেড়ানো ছাড়াও তারা যখন-তখন বাইরে বেরিয়ে হুটোপুটি করছিল। দুপুরবেলা খেয়েদেয়েও দু’ভাই-বোনে দৌড় দিল। বাধ্য হয়েই সুব্রতকে তাদের সঙ্গে যেতে হল।
দুপুরবেলা। তিন চারটে ছেলে এক জায়গায় জটলা করে দাঁড়িয়ে ছিল, হয়তো সারা দিনের এই হাড় ভাঙা খাটুনির মাঝে কিছুক্ষণের বিশ্রাম পেয়েছিল তখন তারা। বিশ্রামের আনন্দটুকু তারা উপভোগ করছিল আরেকজনকে নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করে। তাদের ভাষা স্বাভাবিকভাবেই সুব্রতর বোধগম্য হচ্ছিল না, কিন্তু রসিকতা যে হচ্ছিল তা স্পষ্ট বুঝছিলেন। মাঝে-মাঝেই সে রসিকতা মাত্রা ছাড়াচ্ছিল, ছেলেটির করুণ মুখ আরও করুণ হচ্ছিল, চোখদুটোও জলে ভরব-ভরব করছিল, সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। কাজের তাড়াতেই বোধহয় অন্য তিনটি ছেলে এক সময় চলে গেল তাচ্ছিল্য-ভরা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে, যেন শরীরী ভাষায় বলে গেল, “আচ্ছা এখন এই পর্যন্তই থাক, পরে আবার দেখা যাবে, যাবে কোথায়?”
ছেলেটি তার ময়লা শার্টের হাতায় চোখ মুছল। সুব্রত দেখলেন সে আর কেউ নয়, বিশুয়া। কীরকম অস্বস্তি হল তাঁর, তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। একটু পরে দেখলেন বিশুয়া তখনও যায়নি, দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসেই আছে। সুব্রত পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন তার দিকে, সে শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল। মুখখানা দেখে বড় মায়া হল সুব্রতর, বড়জোর আঠারো উনিশ হবে, কী মেরেকেটে কুড়ি! বাড়ি থেকে এত দূরে এসেছে কাজের জন্যে?
“তোমার বাড়ি কোথায়?” জিজ্ঞস করলেন তিনি।
কী যেন একটা গ্রামের নাম বলেছিল বিশুয়া, আজ আর মনে নেই সুব্রতর, তবে নদীয়ার কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটুকু মনে আছে। সেই এক দারিদ্রের কাহিনি, নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর চেয়েও খানিক বেশি বোধহয়। গ্রামে লোক আসত হোটেলে কাজ করার ছেলে জোগাড় করতে। ওদের পাশের গ্রামের একটি ছেলে এরকম গেছে, হোটেলে কাজ পেয়েছে, বছরে একবার বাড়িও আসে। বিশুয়া আর দেরি করেনি, সে আর তার দাদা দুজনে চলে এসেছিল, পিঠোপিঠি দু’ভাই তারা, দাদা ওর থেকে মাত্র এক বছরের বড়ো।
“তোমার দাদা কই? তাকে তো দেখলাম না?”
“দাদা নাই,” পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটতে-কাটতে বলেছিল বিশুয়া, চোখের দৃষ্টিও ছিল সেই আঁচড়ের দিকেই নিবদ্ধ।
“নাই মানে? চলে গেছে?”
“গেরামে চলে গেছে।”
বুঝেছিলেন সুব্রত যে সে নিজের গ্রামে ফিরে গেছে।
“তুমি গেলে না?”
জোরে-জোরে মাথা নেড়েছিল বিশুয়া, এত জোরে যে আশ্চর্য হয়েছেন সুব্রত।
তাড়াতাড়ি সে প্রসঙ্গ পাল্টেছিলেন, এদিক-ওদিক দু’চারটে অন্য কথার পর জানতে চেয়েছিলেন তাঁর অনুমান সত্যি কি না, মানে ওই ছেলেগুলো ওকে নিয়েই মজা করছিল কি না।
বিশুয়া তার স্থির দৃষ্টি মেলে ধরেছিল সুব্রতর মুখের ওপর, কেটে-কেটে বলেছিল, “আপনে জানলে আপনেও করবেন।”
বিশুয়াকে তখন চলে যেতে হয়েছিল, তার ডাক এসেছিল। কিন্তু সুব্রতর চোখের সামনে ভাসছিল তার সেই দৃষ্টি, মনের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল ওই ক’টা কথা, “আপনে জানলে আপনেও করবেন।”
কী এমন ব্যাপার যা জানলে বিশুয়া সকলেরই পরিহাসের পাত্র হবে? তখন পারেননি, কিন্তু লিটল রণ দেখে চলে যাওয়ার আগে এক ফাঁকে বিশুয়ার কাছ থেকে তা জেনেছিলেন।
সহজে বলতে চায়নি সে। স্বাভাবিক, সুব্রতকে সে চেনে না জানে না, তার ওপর তিনি ট্যুরিস্ট, এসেছেন দু’দিনের জন্যে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে, বিশুয়ার মতো সাধারণ এক হোটেলের বয়ের জীবনের কথায় তাঁর কী প্রয়োজন? নাকি সেই একই কারণ, অন্যের দুঃখ কষ্টকে নিয়ে উপহাস করার সুযোগ পেলে কেউই সে সুযোগ চট করে হাতছাড়া করতে চায় না, তা সে সমাজের যে স্তরের মানুষই হোক না কেন। এ ‘আনন্দ’ উপভোগ করতে চায় না এমন মানুষ সংখ্যায় কম।
“আমিও বাঙালি বিশুয়া, তুমি এই অল্প বয়সে বাড়ি ছেড়ে এত দূরে পড়ে রয়েছ, তার ওপর সবাই তোমাকে নিয়ে এরকম হাসাহাসি করছে, আমার ভালো না লাগাই স্বাভাবিক। তুমি আমাকে সব খুলে বলতে পারো, যদি আমার দ্বারা কিছু করা সম্ভব হয়, আমি করব,” সুব্রত বলেছিলেন।
বিশুয়া শুনে আশ্চর্য হয়েছিল, এক সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ তার জন্যে কিছু করবে, অন্তত তার কথা শুনতেও চাইছে? বিশ্বাস, অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিল কয়েক মুহূর্ত, তারপর সব বলেছিল। ভেবেছিল, বলি, কী আর হবে আর একজন বেশি জানলে? বড়ো জোর সেও হাসাহাসিই করবে, এই তো? তবে এর উপহাস বেশিক্ষণ সহ্যও করতে হবে না, এ তো ট্যুরিস্ট, চলেই যাবে।
রাতে সব কাজ শেষ হলে এসেছিল সে সুব্রতর কাছে, বলেছিল তার জীবন ওলট-পালট করে দেওয়া সে ঘটনা।
গ্রামে থাকতেই সে একটি মেয়েকে ভালোবাসত, নাম তার সোনা। তার সমবয়সীরা জানতও সে কথা। এখানে কাজ নিয়ে আসার আগে সে সোনাকে বলেছিল তার জন্যে অপেক্ষা করতে, হাতে কিছু টাকা পয়সা জমলেই সে আসবে, তাকে বিয়ে করবে। এখানে বছরখানেক কাজ করার পর বিশুয়া আর তার দাদা বাড়ি যাবে বলে স্থির করল। কিন্তু রিসর্টের মালিক একসঙ্গে দুজনকে ছুটি দিতে রাজি হল না, তখনও রিসর্টের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়নি, লোকজনের খুবই প্রয়োজন। ঠিক হল বিশুয়ার দাদা আগে যাবে, সে ফিরে এলে বিশুয়া।
নির্ধারিত দিনে বিশুয়ার দাদা চলে গেল। সে যাওয়ার পর বিশুয়া আবিষ্কার করল তার অতি কষ্টের সঞ্চিত অর্থও তার দাদা নিয়ে চলে গেছে, বলা বাহুল্য তাকে না জানিয়েই। বিশুয়া হাহাকার করে উঠেছিল, বুঝেছিল দাদা আর ফিরে আসবে না এখানে। আক্ষরিকভাবে কর্পদকহীন অবস্থায় শুরু হল বিশুয়ার নতুন করে জীবন সংগ্রাম। তার অনুমান নির্ভুল ছিল। দিন গড়াল, মাস গড়াল, তার দাদা আর ফিরল না। আবার একটু একটু করে পয়সা জমানো, আবার অপেক্ষা করা নিজের গ্রামে ফেরার। প্রায় দু’বছর বাদে যখন গ্রামে গেল দেখল অনেক কিছুই বদল হয়ে গেছে। বিশুয়ার দাদা পাশের গ্রামে একজনের জমিতে কাজ নিয়েছে, বিয়ে করেছে সোনাকে। একটা মেয়েও হয়েছে তাদের।
সে নাকি ফিরে এসে গ্রামে বলেছিল বিশুয়াটা বোকা হাবা ছেলে, কাজকর্ম ঠিক করে করতেই পারে না তো পয়সা রোজগার করবে কী করে! সেই লজ্জাতেই আর গ্রামে আসেনি। তার কথা কেউই অবিশ্বাস করেনি, সোনাও বুঝেছে বিশুয়ার জন্যে অপেক্ষা করে থাকা বোকামিরই নামান্তর, তাই বিশুয়ার দাদাকেই বিয়ে করেছে। বিশুয়া আর থাকেনি গ্রামে, আবার ফিরে চলে এসেছিল এখানেই।
তাকে এত তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে মালিক যথেষ্ট অবাক হয়েছিল।
“তোর দাদার কী হল?” “সে এল না কেন?” “সে কি ওখানেই থাকবে, আর কাজ করবে না?” ইত্যাদি হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিশুয়া আর নিজেকে সামলাতে পারেনি, প্রকাশ করে ফেলেছিল সবই। সেই কাল হল। সকলেরই পরিহাসের পাত্র হল, তাকে রঙ্গ রসিকতার আর সীমা পরিসীমা রইল না। সেই ধারাই চলছে। রিসর্ট থেকে কত পুরোনো ছেলে কাজ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেল, কত নতুন ছেলে এল – কিন্তু বিশুয়ার জীবনের কোনও পরিবর্তন হল না। নতুন যারা আসে তারাও দু’একদিনের মধ্যেই যেন কী করে সব জেনে যায় আর উপহাসকারীদের দলে ভিড় বাড়ায়। বিশুয়া এখন সব মেনে নিয়েছে, ধরে নিয়েছে এই তার ভাগ্য।
“তুমিই বা এখানে রয়েছ কেন? অন্য কোথাও চলে যাও না কেন?” সুব্রত না বলে পারেননি।
“কোথায় যাব!” উদাস স্বরে উত্তর দিয়েছিল বিশুয়া, “মালিক তো মন্দ লোক নয়, আমারে টাকা বেশিই দেয়, অন্য কোথাও এত মাইনা দেবে না।”
সেই বিশুয়া! তার ভালো নাম বিশ্বনাথ, সুব্রত তখন তা জানতেন না, সবাই বিশুয়া বলে ডাকছিল, উনিও তাই জানতেন।
চা খাওয়া হয়ে গেছিল, হাতের কাগজের কাপটা ফেলে দিয়ে সুব্রত আবার বিশ্বনাথের দোকানের দিকে এগোলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মধুছন্দাকে দেখে নিলেন, উনি গল্পে মগ্ন। বিশ্বনাথ বা বিশুয়ার সঙ্গে কথা না বললে সুব্রতর হচ্ছে না। একটু এগোতেই একেবারে তার মুখোমুখি পড়ে গেলেন, সেও তখন দোকান থেকে বেরিয়েছে।
“তুমি মানে আপনি অনেক বছর আগে কচ্ছের রণের একটা গ্রামে ছিলেন না? হোটেলে কাজ করতেন?” সুব্রত বিনা ভূমিকায় জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি যখন আপনাকে চিনতে পেরেছি, তখন আপনিও কি আর পারবেন না?” বিশুয়া উত্তর দিল, কথাবার্তা বেশ পালিশ করা, আগেকার সেই গ্রাম্য টান আর নেই।
“তুমি যে এখন এইসব জিনিসপত্রর ব্যবসা করো, এদিকে আসো বিক্রি করতে – এ জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি, বিশ্বাস করো,” সুব্রত আর আপনি বলার চেষ্টাও করলেন না, নিজের আনন্দটুকু গোপন করারও নয়, “খুব ভালো হয়েছে। হোটেলের কাজ ছেড়ে দিয়ে খুব ভালো করেছ, বিচ্ছিরি কাণ্ড হত ওখানে,” বলেই একটু সংকুচিত হয়ে গেলেন, পুরোনো কথা না তোলাই বোধহয় ভালো ছিল, পুরোনো ব্যথা নতুন করে জাগিয়ে না তুললেই হত, কী ভাবল কে জানে!
বিশুয়া কিন্তু দিব্যি স্বাভাবিক, পুরোনো কথাতে তার কোনও হেলদোল নেই, বরং আরেক পুরোনো কথা মনে করাল সুব্রতকে, “আপনি যাওয়ার সময় আমাকে দুশো টাকা দিয়েছিলেন, তখন দুশো টাকার অনেক দাম ছিল। কোনও টুরিস্ট অত বকশিস দিত না।”
সুব্রত অবাক হলেন, উনি তো ভুলেই গেছিলেন, এ মনে রেখেছে! সত্যিই চলে আসার সময় দুটো একশো টাকার নোট বিশুয়ার হাতে আলাদা করে গুঁজে দিয়েছিলেন, পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, “এটা তোমার। এদের কথায় রাগ কোরো না, অন্য কোথাও ভালো কাজ পেলেই চলে যেও।”
সুব্রত বিস্মিত দৃষ্টি দেখে বিশুয়া বলল, “ভুলে যাব ভেবেছিলেন? কত বছর এদিকে আসিনি, আবার যবে থেকে এইসব মেলায় আসা শুরু হল, আপনার কথা খুব মনে পড়ত, মনে হত যদি আপনার ঠিকানা জানতাম ঠিক দেখা করতাম।”
“দেখা তো হয়েই গেল বিশুয়া, ক’দিন আগে আর পরে, বোধহয় তোমার সত্যিকারের ইচ্ছে ছিল বলেই,” বললেন সুব্রত, “তোমার কথা বলবে বিশুয়া? খুব শুনতে ইচ্ছে করছে, কীভাবে এই ব্যবসায় এলে? চলো কোথাও গিয়ে বসি, ওই ওদিকের দোকানটায় চলো।”
ইচ্ছে করেই একটু দূরে গেলেন, সামনেরটায় মধুছন্দা আছেন, তাঁর বন্ধুরা আছেন, এসব কথা বলার হয়তো অবকাশই পাওয়া যাবে না।
বিশুয়া বলল তার কথা, এমনভাবে বলল যেন সেরকম কিছু ব্যাপারই নয়, “আমার মতো লোকের কথা আর কী শুনবেন? এই ব্যবসা দাঁড় করাতে পেয়েছি আমার বউয়ের জন্যে। ওর হাতের কাজ খুব ভালো। কমলা বাঙালি নয়, গুজরাটি, ওই গ্রামেই ওর বাড়ি। ওদিকের মেয়েদের ছোটবেলা থেকে হাতের কাজ শেখানো হয়, কমলাও শিখেছে। রাত দিন এক করে কাজ করত, ইস্কুলেও যেত না, ওর বাবাই ছাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সেসব জিনিসপত্র বিক্রি করে যা হত তার এক পয়সাও ওর হাতে আসত না। যেন পয়সা রোজগারের যন্ত্র ছিল ও। ওর বাবা আমাদের হোটেলে আসত এইসব ব্যাগ, কুশন কভার এইসব নিয়ে ট্যুরিস্টদের দেখাতে, কখনও-কখনও সঙ্গে কমলাও আসত। তখন চেনা পরিচয় হয়েছিল। আমাকে একদিন বলল, ‘একটা ভালো কাপড় অবধি আমাকে কিনে দেয় না, হাতে একটা পয়সা দেয় না, খালি কাজ আর কাজ! এত পরিশ্রমই যদি করব তাহলে নিজের জন্যেই করব, আমি নিজেই ব্যবসা করব।’ ততদিনে আমার হাতেও কিছু টাকাপয়সা জমেছে, আমিও তো শুধু গাধার মতো খাটতাম আর টাকা জমাতাম, কোনওদিন যদি নিজে কিছু করতে পারি এই আশায়। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলাম দুজনে, অন্য গ্রামে বেশ কিছু দিন থেকেছিলাম। কমলার যা হাতের কাজ তাতে ব্যবসা জমতে সময় লাগেনি, তারপর আবার ফিরে এসেছি ওর গ্রামেই। এখন তো আমাদের বড় কারবার, কমলার কাছে কত মেয়ে কাজ শেখে, কাজ করে। বছরে দু’বার এদিকে আসি। কলকাতার অনেক দোকানেও মাল সাপ্লাই করি। আমার মেয়েও কাজ শিখেছে। এবার ওকে, ছেলেমেয়ে দুজনকেই নিয়ে এসেছি, ওরা কখনও কলকাতা দেখেনি, তাই। কমলাও এই প্রথম এল, দু’জন চলে এলে কাজের খুব ক্ষতি হয়, তাই এত দিন আসেনি। এবার আমিই জোর করে নিয়ে এসেছি।”
“নিজের গ্রামে যাওনি আর?”
“গেছিলাম একবার, মেয়েকে তো তখনই নিয়ে এলাম।”
“মেয়েকে নিয়ে এলে মানে?” সুব্রত আর বেশি কিছু বলে উঠতে পারলেন না।
“ও আমার দাদার মেয়ে। এই মেয়ে হওয়ার পর সোনা আর বেশি দিন বাঁচেনি, এর আগে দুটো ছেলে আছে। দাদা আবার বিয়ে করল, ছেলেদুটোকে নিজের কাছে রাখল আর মেয়েটাকে সোনার বাপের বাড়িতে রেখে এল। ওখানে কেউ দেখত না ওকে, খেতে পরতে পেত না। আমি গিয়ে নিয়ে এলাম। আমার নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছি, ইস্কুলে পড়ে, দশ বছর হয়ে গেল,” বিশুয়া বলল।
“তোমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিল মেয়েকে? বোকা, হাবা বলে আর আপত্তি করেনি?”
“দেবে না? একটা পেট তো কমল।”
“আর কমলা? সে কিছু বলেনি?”
“কমলা খুব ভালো, ও নিজের দুঃখ কষ্টর কথা এখনও ভোলেনি। কেউ দেখে বোঝে না যে ও আমাদের মেয়ে নয়। দুই ভাই বোনেও খুব ভাব। এই দেখুন না, দোকানে বসে না, দুজনে মিলে মেলায় ঘুরে বেড়াবে আর খালি এটা ওটা খাবে!”
“ঘুরতে দাও, এই তো বয়স ওদের। তোমরা এখন তার মানে ওই গ্রামেই থাকো?”
“আমি ফিরতে চাইনি, কমলাই জোর করল। বলল ওখানেই যাব, সবাইকে দেখিয়ে দেব। গিয়ে ভালো হয়েছে। এখন ওই হোটেলে আমরাই যাই মালপত্র নিয়ে ট্যুরিস্টদের দেখাতে। কমলার ভায়ের মেয়েরা আসে ওর কাছে কাজ শিখতে,” বিশুয়া হেসে বলল।
সুব্রত দেখছিলেন বিশুয়াকে, মুগ্ধ হয়ে। কোথায় সেই করুণ মুখের মুখচোরা ছেলেটা যে চোখ তুলে তাকিয়ে কথাই বলতে পারত না, যাকে অন্যরা যথেচ্ছ উপহাস করত আর কোথায় এই আত্মপ্রত্যয়ী বিশ্বনাথ! অবশ্য সময়টা নেহাত কম নয়, দু’দশক, পরিবর্তন স্বাভাবিক আর মানুষের পরিবর্তনও কম দেখেননি সুব্রত, তবে সেসব দেখে মনে কষ্টই পেয়েছেন। তাই বোধহয় আজ অন্ধকার কাটিয়ে এই আলোয় ফেরা চাক্ষুষ করে মন এক অদ্ভুত ভালো লাগায়, আনন্দে কানায়-কানায় পূর্ণ হল।
বিশুয়া উশখুশ করে উঠল, তার দোকানে ভিড় বাড়ছে, সবকিছু একা সামলাতে কমলা নিশ্চয়ই হিমশিম খাচ্ছে।
“তোমাদের জিনিসপত্র আমার স্ত্রীর খুব পছন্দ হয়েছে, তোমার কার্ড যত্ন করে রাখা আছে।”
“কিছু দরকার হলে ফোন করবেন, আমি ক্যুরিয়রে পাঠিয়ে দেব। সারা দেশে এরকম কত পাঠাই আমি!”
বিশুয়া চলে গেল। সুব্রত কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থাকলেন। মেলা সত্যিই মিলিয়ে দেয়! গুজরাট থেকে ফিরে আসার পরও কয়েকবার মনে পড়েছে বিশুয়ার কথা, মনে হয়েছে এখনও কি সে সেখানেই পড়ে আছে? সেই একই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে? তারপর প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততায় সে কখন যেন চলে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে। কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে আজ এই মেলায় এইভাবে বিশুয়াকে দেখবেন।
“এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?” মধুছন্দার গলা শুনে ঘুরে তাকালেন সুব্রত।
“তোমার কেনাকাটা শেষ হল?” কী করছেন সে কি আর এক কথায় বলা যায়? তার থেকে পালটা প্রশ্ন করা বরং ভালো মনে হল সুব্রতর।
“আমি ওদের সঙ্গেই ঘুরে নিলাম, তুমি তো দেখলাম ওই দোকানে ছিলে, ডাকিনি আর, তুমি তো ঘুরতে চাও না।”
“ভালো করেছ, এবার বাড়ি তো?”
“হ্যাঁ, আর পারছি না বাবা, অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। তবে মেলাটা ভালো হয়েছে, অনেক কিছু দেখলাম।”
“আমিও,” বললেন সুব্রত, তবে সে কথা মধুছন্দার কানে পৌঁছল কি না সন্দেহ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন