short-story-modhyo-raater-carnival

মধ্যরাতের কার্নিভাল
রুমা মোদক

‘নূরবানু, নূরবানু’ প্রতিদিন মধ্যরাতে এই ডাকটা আমার আম্মার শেষ ডাকের মতো শোনায়,শুধু খালের উপর বাঁধা এক বাঁশের সাঁকো পার হবার মতো আতঙ্ক বুকে হাতুড়ি পেটাতে থাকে, মনে হয় আম্মাশেষ বিদায় নিতে ডাকছেন। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠি।আম্মা কী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন? নাকি পায়খানা, প্রস্রাবে ডায়াপার ভরিয়ে আর সহ্য করতে পারছেন না?আম্মা মাসখানেক জীবন্মৃত বিছানায় পড়েআছেন, সারা শরীর খুবলে খুবলে নিচ্ছে ঘা, যতো দিন যায়, ঘা দগদগে হয়। মুখের সামনে লবণ দেয়া ভাতের লেই ধরলে হা করে গিলেন। কোন হুঁশ জ্ঞান নেইখালি ডাকেন ‘মজনু, মজনু’। আমি বাসায় থাকলেও ডাকেন, না থাকলেও ডাকেন।

নাছিমা খুব বিরক্ত হয়।হয়তো সন্ধ্যা রাতে চুলায় ছেলের বায়নামেটাতে সদ্যকেনা আইফোনে ইউটিউব চালিয়ে চিলি চিকেন চাপিয়েছে কিংবা চিতল মাছের কোপ্তা।গতকাল মার্কেট ভিজিট করে ফিরে আসার সময় এক অখ্যাত গ্রামের বাজারে হঠাৎ পেয়ে যে চিতল মাছটা কিনে এনেছি, তারই প্রিপারেশন মাত্রই ডুবো তেলে ভাজতে বসিয়েছে, তখনই আম্মা জোরে জোরে ডাকেন, ‘মজনু, মজনু….’। দৌড়ে মায়ের ডাক শুনতে গিয়ে নাসিমারচিলি চিকেন রেসিপিতে সস, কর্ন ফ্লাওয়ার দেওয়ার কিংবা কোপ্তা ভাজার টাইমিং গড়বড় হয়ে যায়। তবু যদি গিয়ে দেখা যেতো কোন কাজে ডাকছেন, একেবারে অহেতুক। বাসায় ফিরলে নাছিমা প্রতিদিন অভিযোগ করে।

কেউগভীর রাতে ডাকে ‘নূরবানু…নূরবানু…’।আমিহঠাৎ ভেঙে যাওয়া ঘুম ঘুম চোখে কান পেতে শুনি, খুব ভালো করে শুনি, হ্যাঁ নূরবানুকেই ডাকেন তিনি, অথচ আমি শুনতে পাই ‘মজনু…মজনু…’,মনে হয় আম্মা ডাকছেন ‘মজনু…মজনু…’। শেষের এই ‘নু’….মজনুর না নূরবানুর ধাতস্থ হয়ে বুঝতে আমার ক্ষনিক সময় লেগে যায়।মূলতআম্মা তখন কড়া ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমান,আমাকে ডাকেন না। কিন্তু যতটা সময় আমি বাসায় থাকি, আমি চাই আম্মার যেন যত্নের অভাব না হয়।কিংবা মায়ের সেবার ক্ষেত্রে কোন আলস্যজনিত অবহেলার অনুতাপ আমার মাঝে জেগে না থাকুক, কখনো নয়।অফিস থেকে ফিরেই আমি মায়ের কাছে যাই, ডায়াপার বদলে দেই। বেডসোরে মলম বুলিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই।

ঠিক করি কালসকালেই ড্রাইভার সোবহানকে জিজ্ঞেস করবো,এই নূরবানুটা কে? কোনটা তার বাড়ি? কে তাকে ডাকে প্রতিদিন, কেনই বা ডাকে? ভাবতে ভাবতে আমি পেশাগত ক্লান্তির নিরুপায় চাপে আবার ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাই, সাঁতার না জানা যাত্রীর মতো।পরদিনডাইনে বাঁয়ে জলজংলা পেরিয়ে পিচ করা রাস্তা ধরে অফিসের গাড়িএসে বাসার সামনে দাঁড়ালে আমি নূরবানুর কথা বেমালুম ভুলে যাই।ভুলে যাই কোনদিক থেকে কে কাকে রাতে ডেকেছিল।সকালে অফিসের একগাদা কাজের তাড়া আমাকে আর বাকি সব গুরুত্বপূর্ণ অগুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন অপ্রয়োজন ভুলিয়ে দেয়। গাড়িতে উঠার আগে আমি স্মার্টফোন ঘেঁটে হিসাব মিলাতে থাকি, কোন কোন মার্কেট ডাউন, কোন মার্কেট আজ ভিজিট না করলেই নয়। মাথাটা পুরোপুরি ঢুকিয়ে দেই মার্কেটিং পলিসিতে, জবের এই প্রেসারছাড়া বাকি সব ইরেজ হয়ে যায় পরীক্ষার খাতায় ভুলভাল আঁকা জ্যামিতির মতো।কেবল জেগে থাকে কোম্পানির লাভ ছেঁকে তোলার লক্ষ্যটা।

গাড়িটিআবার ঘড়ি ধরে দুপাশে জলজংলার বুক চিরে পিচের মসৃণ রাস্তা ফুঁড়ে ফুস করে বেরিয়ে যায়। এই রাস্তাটাআমার ক্যারিয়ারের মতোই মসৃণ।খুব যত্ন আর পরিকল্পনা করে বানানো। মহা পরিকল্পনার প্রথম ধাপ। সামান্য ছিট কাপড়ের দোকানদার পিতার ছেলে আমি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড়সড় কর্মকর্তা।নিজের নতুন বাড়িটি করেছি শহরের বাইরে এসে এই জলজংলাতেই।আজকের বর্তমানের দিকে তাকিয়ে নয়, নিকট ভবিষ্যতের উজ্জ্বলতার ভরসায়।একমাত্র আম্মার সায় ছিলো। নইলেচেনাজানা সবাই না করেছিলো, এখনো আমার মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কর্মকর্তাদের থাকার জন্য যথেষ্ট ভদ্রস্থ হয়ে উঠেনি পাড়াটা। যে দু’চার ঘরের বসবাস, সবই উটকো লোকজন। কিন্তু আমার দূরদৃষ্টি ঠিকই খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে এই এলাকাটাই হতে যাচ্ছে শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা। শহরতলীর বিস্তীর্ণ জায়গায় এই আবাসিক এলাকা বানানো পুরোটাই মাস্টারপ্ল্যানের আওতায়।এর বাসিন্দাদের জন্য আলাদা ব্যাঙ্কোয়েট হল,কিন্ডারগার্টেন স্কুল, খেলার মাঠ, জগিংয়ের রাস্তা সব গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে।ভাগ্যিস আব্বা এখানে এক টুকরো জমি কিনে রেখে গিয়েছিলেন! নইলেশহরের মাঝে এতো বড়ো প্রিমিসিসে এখন জায়গা কেনাই দুষ্কর।পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া হাইওয়ে জায়গাটার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।অথচ তখন কেউ ভাবেনি, ইয়া উঁচু উঁচু কুচুরিপানার ঝাঁকের নিচে ঘোলা পানি, সাপ খোপ জোঁক আর ব্যাঙের রাজত্বে কোনদিন মানুষ দাপিয়ে বেড়াবে। অথচ তখন পানির দরে বিক্রি হয়েছে জলাভূমিটা। বছর কয়েক আগে জলজংলার বুক চিরে তৈরি করা হয়েছে পিচের রাস্তা আর তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে গোটা কয় বাড়িঘর, শপিং মল, সিনেপ্লেক্স, হাসপাতাল ইত্যাদি অলংকার আর আমার মতোই অভিজাতদের নিজস্ব অট্টালিকায় বছর পাঁচেক-এর মধ্যে পুরো চেহারাটাই বদলে যাবে।

এই শহরটার প্রতি আলাদা মায়া আছে আমার। গ্রাম ছেড়ে এই শহরে এসে বাসা ভাড়া করে আব্বা কাপড়ের দোকান দিয়ে বসেছিলেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কথা ভেবে। আমি প্রাইমারি স্কুলে বৃত্তি পাওয়ার পর শচীন্দ্র স্যার আব্বার মাথায় পড়ার পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, “এত্ত পরিষ্কার মাথা ছেলেমেয়েগুলার, কুদ্দুছ মিয়া ওদের পড়ায় লাগাইয়া রাখো।” সামনে ছিলো গাঁয়ের হক সাহেবের বাড়ির উদাহরণ। চার ছেলের সবাই তখন পড়ালেখা শেষ করে দেশান্তরি। গ্রামের ছনের ছাউনি দেখতে দেখতে অট্টালিকা, ঢোকার মুখে “হক হাসপাতাল”, গ্রামের একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র।আর যায় কই, ছেলেমেয়েদের ঘিরে আব্বার ভবিষ্যৎ স্বপ্নও হক সাহেবেরসন্তানগর্বের কাছাকাছি ঘুরাঘুরি করে, আর তিনি ডাইনে বামে না তাকিয়ে, গ্রামের যা যৎসামান্য জায়গা জমি সব বেচাবিক্রি করে শহরে এসে উঠেন। তার চেষ্টা বিফল হয়নি।তারও চার ছেলেমেয়ের একজন বিলাত, দুইজন রাজধানীবাসী- অত্যাধুনিকফ্ল্যাট, গাড়ি, ব্যাংকক-থাইল্যান্ড আর আমি আবার এখানে ফিরে এসেছি বেশ দাপুটে চাকরি নিয়ে। আমার অধীনে চাকরি করে কয়েকশ লোক।

এই শহরে আমি বড় হয়েছি। এর মাঠ, ঘাট, গলি ঘুপচি একসময় হাতের রেখার মতো মুখস্থ ছিলো। যদিও উন্নয়নের ছোঁয়ায় সেই ছেলেবেলার পথ ঘাট সব পথ হারিয়ে অচেনা হয়ে গেছে, তবু মার্কেটিং এর ব্যস্ত জীবনে গাড়িতে বসে হঠাৎ জানালা খুলে দিয়ে আমি ঘোষপাড়ার মোড়েঅমলকে দেখতে পাই, চৌধুরী বাড়ির গেটে আমগাছে ঢিল দিচ্ছে। নকীবকে দেখি দুপুরের রোদ পড়ার আগেই ফুটবল নিয়েবাড়ির বাঁশের বেড়া টপকে পালিয়ে চলে এসেছেনায়েবের মাঠে। রবীনকে দেখি, রাতজেগে কাটা মোরগের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে দাঁড়িয়ে আছে তানিয়াদের গেটের উলটা দিকে। তানিয়া চিঠি পেয়ে ভাববে আহারে কী তীব্র প্রেম ছেলেটার, নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছে।এ শহরের আনাচে কানাচে আমার বড় হয়ে উঠারঅমূল্য ঘ্রাণ। নকুলের দীঘি, কুল উপচানো জল, নায়েবের মাঠ, কাদামাখা ফুটবলের বিকাল আর পুকুরে ডুবিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে এসে ঝিমানো, ঘুমে ঢুলে পড়া। আব্বার ফেরার সময় হলেই মা ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিতেন, আর আমি বই খুলে সুবোধ ছেলের মতো টেবিলে বসে গভীর মনোযোগের ভান করতাম, তবু কোন কোনদিন আব্বা দেখে ফেলতেন বইয়ে মাথা রেখে ঢুলছি, দরজার সামনে পাতাবাহার গাছের ডাল পিঠে ভাঙতেন! গালি দিতেন,“ম্যারাডোনার বাচ্চা,তোরে নিয়াএজন্য টাউনে আসছি আমি, মাঠে খেলবি আর সন্ধ্যায় পইড়া ঘুমাবি!”সেই সেবার, যেবার বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা মাঝ মাঠ থেকে এক গোলদিয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল।

মার্কেটটাতে নেমে একটু থমকে যাই আমি।আরে এটাতো নায়েবের মাঠ।ফি বছর কার্নিভাল হতো এখানে। আশেপাশেই ছিলো আমাদের ভাড়া করা বাড়িটা, ডেন্টিস্ট পরিমল বাবুদের পূবের ভিটার একচালা ঘরে ভাড়া থাকতাম আমরা,গেট লাগোয়া সারিসারি টিনের প্রাচীর দেয়া ঘর,বেশ কয়েকঘর ভাড়াটিয়া, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। টিনের গেটের পাশেই একটা লাল জবার গাছ।আমাদের জন্য নিষেধ ছিলো সেই গাছে হাত দেয়া।পরিমল ডেন্টিস্টের মা ধলা ঠাকুরমা প্রতিদিন ভোরে স্নান সেরে গাছের ফুলগুলি আলগোছে তুলে নিয়ে, আগের দিনের বুজে যাওয়া ফুলগুলি গাছের নিচেই ফেলে যেতেন। আমরা দূর থেকে দেখতাম সারাদিন ফুলগুলি বারান্দার ঠাকুরঘরের ঠাকুরের পায়ে জ্বলজ্বল করতো। ধলা ঠাকুরমা ঠাকুর ঘরে বসে বসেমাটির চুলায় লাকড়ি ঠেলে ঠেলে পিতলের কড়াইয়ে পিতলের খুন্তি নেড়ে নেড়ে নারিকেলের নাড়ু আর ক্ষীরের সন্দেশ বানাতেন। কী সুন্দর গন্ধ সেই নাড়ু সন্দেশের। পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দুরন্ত বালিকার নাচতো গন্ধটা। আর আমাদের জিভে জল জমতো।মাঝেমাঝে আমাদের ডেকে খেতে দিতেন ধলা ঠাকুরমা। আমরা বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াতাম আর ঠাকুরমা বারান্দার উপর থেকে হাতে ছেড়ে দিতেন। চাইলে আরেকটা দিতেন,আর বলতেন সাবধান ফুল ছিঁড়বি না কিন্তু। ঠাকুরমার নাড়ু সন্দেশের লোভে আর আব্বার কড়া নিষেধের কারণে আমরা কক্ষনো ফুলগাছে হাত দিতাম না। কোথায় জবা ফুলগাছ, কোথায় ঠাকুমার রান্নাঘর। এখানে এখন ছয়তলা ফ্ল্যাটবাড়ি। বারান্দায় ঝুলানো আন্ডার গার্মেন্টস, শুটকি রান্নার গন্ধ আরসিরিয়ালের উচ্চস্বরের ঝগড়া পাল্লা দিচ্ছে খোলা জানালার পর্দা ডিঙিয়ে কোনটা আগে হামলে পড়বে আমার উপরে!

সারিসারি কয়েকটি ঘর। কয়েকটি নয় অনেকগুলি। নানারকম দোকান। একটায় পুতুলের সারি, পাশে একটা ঘরে অদ্ভুত কিছু কুমড়ো, বিশাল বড় বড়,প্রদশর্নীর জন্য রাখা। একটা বোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘বিক্রয়ের জন্য নয়’। এর পাশে খামার বাড়ি, মাটি দিয়ে বানানো ছোট ছোট গরু ছাগল, বয়ে যাওয়া নদী, ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়ে ঘর, বনের ঝাঁপি, আদর্শ গ্রামের এক্সিবিশন। একটা সবুজে ছাওয়া মাঠ।যেন পুরো একটা গ্রাম। পুতুলেরই মতো ছোট ছোট মানুষও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এর পাশে বিস্কিটের দোকান, ঘিয়ে ভাজা নারকেলের বিস্কিট, টোস্টের মৌ মৌ গন্ধ।পাইন এপেলের টিনের কৌটো, সারি সারি প্যাকেট।পাশেই সিঙাড়ার ঘর, ভাজার তীব্র গন্ধ।একটা প্লেটে নিয়ে খেতে বসে যাই আমি। সাথে টমেটোর সালাদ। একটা খেয়ে আরো কয়েকটা খেতে ইচ্ছে করে। পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকা নেই,মানিব্যাগটাকি বাসায় ফেলে এসেছি?ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, তখনো একটার বেশি দুটো সিঙাড়া খেতে পারতাম না টাকার অভাবে, আর ভাবতাম বড় হলে রোজগারের টাকায় খালি কার্নিভালের সিঙাড়াকিনে খাবো।

আরে আমার তো মার্কেট ভিজিট করতে আসার কথা, আমি এই কার্নিভালেএসে কেন ঢুকলাম? ভুল করে? সম্ভবতভুল করেই। আচ্ছাআমাদের বাসার পাশে নায়েবের মাঠের এই কার্নিভালটা না আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলোসেবার! কার্নিভালের মাঠ ঘুরে রাস্তায় বেরোতেই না মিছিলের মুখোমুখি পড়েছিলাম। সেই কার্নিভালটা তো ? আবার হচ্ছে নাকি! সবতো দেখি আগের মতোই।ধুর, বোধহয় পুড়ায়নি সেবার। আমিই ভুল জেনেছিলাম।এসেই যখন পড়েছি ঘুরে দেখি। আব্বার ভয়ে ছেলেবেলায় কখনোই তৃপ্তি মিটিয়ে ঘুরতে পারিনি।

মাইকের তীব্র আওয়াজ শোনা যায়, ‘হাউজি হাউজি, বাম্পারবাম্পার’। পাল্লা দিয়ে পাশের মাইকে ‘আজ রাতে দেখুন আয়নাবিবির পালা’। ডানা কাটা পরি সুচরিতা ও ড্যাশিং হিরো ওয়াসিম অভিনীত যাত্রাপালা ‘আয়নাবিবির পালা’। ঘুরতে ঘুরতে আমি বাঁদিকের তাঁবুতে উঁকি দেই, সারি সারি বেঞ্চ আর নিচে ছড়িয়ে থাকা কাগজের স্তুপ। একটা বুড়ো মহিলা নুয়ে নারিকেলের পাতার শলা দিয়ে ঝাট দিয়ে এক করছে ঘরময় ছড়ানো ছিটানো কাগজগুলো।পাশেই আরেকটা তাঁবু।মেয়েছেলেদের অনুচ্চ ফিসফিসানি।আমি পাশের তাঁবুতে চুপি দেই।এক এলাহি কাণ্ড সেখানে।মাটিতে সারি বেঁধে ঘুমাচ্ছে নারী পুরুষ নির্বিশেষে। নানান বয়সী।কারো মাথার দিকে পা, কারো পায়ের দিকে মাথা, পেট বরাবর একজনের পা, আরেকজনের মাথা লেগে আছে অন্যজনের পিঠে। ঘুমন্ত চেহারাগুলোয়ও জেগে আছে রাত জাগা ক্লান্তি। শুধু খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে এক নারী, শুধু রাতজাগা ক্লান্তি নয় তার চোখের চারপাশে তার জমাট বেঁধে আছে পুরো জনমের ক্লান্তি। পরনে শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ। স্তনে ঝুলে আছে একটা বাচ্চা, মাথায় ঝুঁটি বাঁধা। নারীটির দৃষ্টিতে উদাসীনতা। আরেকজনকে দেখি ঘরের এক কোণে টিনের থালায় পানি দেয়া ভাত খাচ্ছে পেঁয়াজ কাঁচা মরিচে গোগ্রাসে।

বাইরেকুড়াল দিয়ে রান্নার খড়িকাঠ কাটছে একজন। মাঠে গোল হয়ে বসে বয়স্ক কয়েকজন। হাতে হুক্কা। তামুক আর টিক্কা পোড়া গন্ধ।গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ প্রত্যেকের চেহারায়। যেন সেই তাঁবুতে বসে থাকা নারীটির দুশ্চিন্তার ছাপের সম্প্রসারণ। ফিরে আসার সময় আবার একটু চুপি দেই তাঁবুর প্রবেশদ্বারে। কী মনে করে হঠাৎ তাকায় নারীটি, এখন তাকে জীবনের ভারে বীতশ্রদ্ধ এক নারীই লাগে আমার। চোখের নীচে তারই ক্লান্ত কালো ছাপ,থুতুনির গোড়ায় ছোট্ট একটা তিল, অবসন্ন বসে থাকা।পেটিকোট উঠে আছে হাঁটু পর্যান্ত, ব্লাউজের নিচে ঝুলছে অনার্কষনীয় স্তন।তবু চেহারাটাকোথায় যেন সেই সাদাকালো টিভিতে দেখা গানটির কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘যাদু বিনা বাঁশি যেমন….’।নামটার জন্যই বোধহয়। কিন্তু ও আসল সুচরিতা নয়, অধিকারী ওর নাম দিয়েছে সুচরিতা।সুচরিতা আমাকে ইশারায় ডাকে। আমি দুরুদুরু পায়ে ভেতরে ঢুকি।ভেতরে সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সুচরিতা জিজ্ঞেস করে, “যাত্রা দেখবা?” আমি মাথা নাড়ি। সুচরিতা হাসে তার থুতুনির তিলের উপরে ছোট্ট একটা টোল পড়ে, “কেন তোমার বাড়ির মানুষ বলেনা, যাত্রা দেখলে ফাত্রা হয়?” আমার মনে পড়ে, মাইক বাজিয়ে যাত্রাপালার ঘোষণা শোনা গেলেই, ধলা ঠাকুরমা ঠাকুরের নাম জপেন, “ঠাকুর- ঠাকুর”, আর বলেন“যাত্রা দেখলে ফাত্রা হয়!”সত্যিতো! কিন্তু এটা সুচরিতা কী করে জানলো? সুচরিতাকে তো সে কোনদিন তাদের বাসায় যেতে দেখেনি!আমার চোখের বিস্ময় নিমিষে পড়ে নিয়ে সুচরিতা বলে, “আমি সব জানি রে ব্যাটা, সব জানি।” আঙুল দিয়ে বাইরে ঝাঁকরা চুলের লোকটি, যাত্রা দলে যার নাম ওয়াসিম তাকে ডাকতে বলে। আমি উঠে দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করেন, “তোর নাম মজনু না?”বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে সে।নামটি কী যে হাসির ফোয়ারা ছোটায় তার চোখেমুখে। বলে, “যা আজ রাতে পালা দেখতে আইস। টিকেট লাগবে না। আমি বলে রাখবো, মজনু আসবে।”বলে আবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে সুচরিতা।“মজনু… মজনু…” বলে আবার একা একাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। মজনু নামের মধ্যে এতো হাসার কী আছে কে জানে!

শহরে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদের মিছিল হচ্ছে প্রতিদিন। কার্নিভালের নামে বেলাল্লাপনা বন্ধ কর,করতে হবে। আব্বা দোকান থেকে তীব্র রোষে ঘরে ফিরেন। দোকান মালিক সমিতিরমিটিংয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন তিনি। এসব না করলে কী!যত্তোসব না-জায়েজ কাজ,উঠতি পোলাপানের মাথা নষ্ট। দীনের পথভ্রষ্ট করা। আম্মা প্রতিবাদ করেন, “তো মানুষগুলারে অন্য কাজ দেন, এরা এই করে খায়, বন্ধ কইরা এদের না খাইয়ামারবেন নাকি?”আমার খুব মন খারাপ হয়। কার্নিভাল হচ্ছে বলে আমাদের সন্ধ্যাগুলো একটু অন্যরকম হয়েছে ইদানিং। আম্মা দুদিন আমাকে মাসুদমামার সাথে সার্কাস দেখতে পাঠিয়েছেন।ইয়া বড় বড় হাতি, বানর খেলা, রংচটা পোশাক পরা জোকার। রিং ধরে মেয়েদের কী অসাধারণ শারিরীক কসরত! মুখের ভেতর থেকে আগুন ছুঁড়ে মারার চোখ ধাঁধাঁনো কৌশল, বোর্ডে পিঠ ঠেকিয়ে যে মেয়েটি দাঁড়ায় আর চারদিক থেকে তেড়ে আসা ছুরি তাকে অক্ষত রেখে চারদিক থেকে বিঁধতে থাকে,প্রাণটা তখন ঠিক কানের কাছে এসে লাফাতে থাকে।মাসুদমামা বাড়তি হিসাবে পুতুলনাচ দেখাতে নিয়ে যায়। পুতুল নাচের ছোট্ট পুতুলগুলি, ঘাগড়া পরে বলতে থাকে, ‘সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি।’

আমার মন পড়ে থাকে পাশের তাঁবুতে। সেখানে রাজা,রানী, প্রজা,উজির, নাজিররা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামার কাছে বায়না ধরি “মামা আমি যাত্রা দেখবো।” মামা দ্রুত আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে।তখনই পেছন থেকেসুচরিতা ডাকে, “আরে মাসুদ ভাই, আইবেন না আইজ? নওশাদ ভাই কই?ওমা সাথে এটা কে? মজনু না?” সকালের কালো ছোপ ঢাকা পড়ে গেছে কয়েক পরত মেকাপের নিচে। আলো আঁধারীতে চকচক করছে চেহারা,এ অন্যরকম সুচরিতা।দুপুরে দেখা যে কোন নারী নয়।একেবারে রাজরানী, চেনা যায়না। “আসব-আসব”, বলে দ্রুত পাশ কাটায় মাসুদমামা। কাঠের তেরচা হুড়কো দেয়া চেয়ার মেলে দিয়ে সিঙাড়ার অর্ডার দেয় অদূরে “মোদক মিষ্টান্নভোজন” এ ঢুকে। আমার কানে তখনো বেজেই চলছে, ‘আজ দুইশতম রজনী’ …বেয়ারা এত্তো বড় বড় সিঙাড়া প্লেটে দিয়ে যায়।আমার মন সিঙাড়ার আলু ফেলে বারবার চলে যায় যাত্রার তাঁবু থেকে ভেসে আসা গানের দিকে, ‘আমরা তো বানজারান…’ আমার ভেতরে রাজা রানীরপার্ট দেখার অপার তৃষ্ণা বাঁধ মানে না। মাসুদমামা সামনে একটা বোতল ধরে দেয়, “খেয়ে দেখ কী জিনিস! জীবনেও খাস নাই।” আমি পাইপে মুখ লাগিয়ে টান দিতেই ভেতর জ্বলে যায়, কী অসহ্য! মুখ থেকে ছুঁড়ে ফেলে খেপে উঠি আমি, “কী দিলা মামা, আমি ভাবলাম কত মজা!”আমাকে নিয়ে মজা পায় মাসুদমামা, “ধুর তুই আর স্মার্ট হইবি না।”বাসায় ফিরে আম্মার কাছে ঘ্যানঘ্যান করি, “ওমা যাত্রা দেখবো।” আম্মা আমাকে চুপ থাকার ইশারা দেন, “এই না জায়েজ কাজে আব্বা কোনমতেই সমর্থন দিতে পারেন না।”তবু আম্মা পাতে ভাতের সাথে পাবদার ঝোল তুলে দিতে দিতে সাহস করে বলেন, “চলো না গো, বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আমরা একদিন দেখে আসি।আমারও যাত্রা দেখার খুব শখ।” আব্বা আরো ক্ষেপে যান।“নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ! এ যে ঘরের শত্রু বিভীষণ দেখতাছি!”রাতে আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ঘুমাতে বলেন, “একদিন আমি আর তুই লুকিয়ে মাসুদের সাথে যাত্রা দেখতে যাবো। তোর আব্বা টেরও পাবে না।” রাতে আমি কান খাড়া করে থাকতাম, কখন মাসুদমামা গেট খুলে বাইরে যায় আমি ঠিক শুনতে পেতাম।নওশাদমামা গেটে টোকা দিতেন, আর মাসুদ মামা গেট টপকে বেরিয়ে যেতেন।বুঝতাম আম্মা টের পেলেও টের না পাবার ভান ধরে থাকতেন।

রাতে আবার কেউ ডাকছে ‘নূরবানু, নূরবানু’। আমি শুনতে পাই আম্মা ডাকছেন, ‘মজনু মজনু…’। আমি দরজা খুলে বাইরে আসি। দূর থেকে দেখা যায় টিনের চালা দেয়া একতলা বাড়িটি।বারান্দার কোনায় টিমটিম করে জ্বলছে বাজারে নতুন আসা এলইডি বাতি। বারান্দার নিচে সিঁড়ির দু’পাশে বেপরোয়া বেড়ে উঠা কচুর ঝোপ, কে জানে কতদিন কেউ পরিষ্কার করেনা বাড়িটা!কারো সিটকিনি খুলে দেয়ার বিরক্ত আওয়াজ। কাল জানতেই হবে বাড়িটি কার। কে থাকে এই বাড়িটিতে? সকালে ঘুম ভাঙে এমডির ফোনে। মাস ফুরিয়ে আসছে, টার্গেটের ধারেকাছে নেই বিক্রি। এরিয়া ম্যানেজারকে ফোন করি, কয়েকটা মার্কেট ভিজিটে যাব আজকেই, নিশ্চয়ই সেলসম্যানরা যায় না প্রতিদিন! যথারীতি মার্কেট ভিজিটের তাড়ায় ভুলে যাই নূরবানুর কথা।

মার্কেট ভিজিট করে ফেরার সময়কী এক অপ্রতিরোধ্য আহ্বানে আবার কার্নিভালের মাঠে নেমে পড়ি। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ‘শ্রীরাধা-মাধব অপেরা’ পার্টির তাঁবুর সামনে। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক।বিশাল মিছিল হয়েছে শহরে। তাঁবুর ভেতরে সবার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। সবচেয়ে বেশি সুচরিতার মুখে। বাচ্চাটি চিৎকার করছে, তিনি উৎকণ্ঠিত দাঁড়িয়ে আছেন, অধিকারী, ম্যানেজার আর ওয়াসিমের সামনে।একটাই প্রসঙ্গ। এবছর শীত ফুরিয়ে আসছে। আর বায়না নেই। এটাই শেষবায়না, সামান্য টাকাই পেয়েছে তারা বায়নায়। ঠিক কার্নিভালের হর্তাকর্তা দোকান মালিক সমিতির নেতারা লাভ হয়নি বলে বাকি টাকাটা আর দেবেনা। কই যাবে এরা এরপর? এসব উদ্বেগাকুল কথার মাঝেও সুচরিতা আমাকে দেখে ইশারায় ডাকে। আমি কাছে গেলে জানতে চায়, “তোমার মাসুদমামা কই? নওশাদমামা? একটু দেখা করতে বলবা, খুব বিপদে পড়ছি যে!কার্নিভাল বন্ধ হয়ে গেলে পথে নামতে হবে, ভিক্ষা করে খেতে হবে!”আমার কষ্ট লাগে, আহা বেচারি ট্রাঙ্কের উপরে সিরাজউদ্দৌলার মুকুট, তাঁবুর দড়িতে হেঙারে মমতাজের ঘাগড়া। একটু পরেই দর্শকসিরাজউদ্দৌলার দুঃখে কাঁদবে, মমতাজের প্রেমে আপ্লুত হবেঅথচ কি অনিশ্চয়তার জীবনএদের!

মাসুদমামা, নওশাদমামা অনেক বড় ছাত্রনেতা, রাজপথে শ্লোগান দেয়‘একদফা একদাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি?’ তাদের পেছনে পেছনে শ্লোগান দেয় শত শত কলেজ ছাত্র, ডিসি, এসপি মিটিংয়ে ডাকে, আবার হরতালের পরে পুলিশ এসে এদেরকেই খোঁজে। তবু এরা চাইলে যে এই ছোট শহরে অনেক কিছু পারে, এমনকি এই কার্নিভালও চলতে দিতে পারে আমি জানি।বাইরে বের হয়ে আমি তাজ্জব, বিরাট মিছিলের সামনে নওশাদমামা আর মাসুদমামা। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছে মাসুদমামাআরপাশে হ্যান্ডমাইক ধরে দাঁড়িয়ে আছে নওশাদমামা। “সংস্কৃতির নামে এই বেলাল্লাপনা চলতে দেয়া যায়না। অচিরেই যদি কার্নিভালের নামে এই অপসংস্কৃতি বন্ধ করা না হয়, তবে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।” আমি মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনি। এই মাসুদমামাকে আমার অচেনা লাগে। এই মাসুদ মামাই না প্রতিদিন নওশাদমামার সাথে সারারাত জেগে যাত্রা দেখে! একী বলছে সে? মনে মনে ঠিক করি আজ সব আম্মাকে গিয়ে বলে দেবো। আম্মাকে খুব ভয় পায় মাসুদমামা।আম্মা ঠিক একটা ধমক দিলেই চুপ হয়ে যাবে। আর লোক ক্ষেপিয়ে তুলবে না।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে,আরে মাসুদমামাকে এখন পাবো কই? মাসুদমামা তো অনেক বছর আগে ডিভি লটারি পেয়ে আমেরিকা চলে গেছে।নওশাদমামাকে খুঁজে দেখতে পারি।নওশাদমামাকে খবর দেয়ার আগে সেদিন রাতেই একদল লোক হইহইরইরই করতে করতে তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে কার্নিভালের মাঠে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি ছাড়া আর কিছুই দেখিনা আমি। রাতারাতি এই হাতি ঘোড়া এতগুলো মানুষ সব শুনশান বিরান ভূমি বানিয়ে কোথায় চলে গেলো, সে উত্তর আমি আর কারো কাছে পাইনা। আহা আমার আরআম্মার ‘রূপভান’, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ দেখা হলোনা। শুনেছি পুলিশ এসে লাঠি, ফাঁকা গুলি আর টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে সামালদিয়েছিল পুরো পরিবেশ। আম্মার সেবার কী রাগ, কী রাগ! “এটা কোন কথা! রাতের অন্ধকারে এতগুলো মহিলাকে বাচ্চাকাচ্চা সহ তাড়িয়ে দেয়া,এরা যাবে কই এত রাতে! এ কেমন বিচার?”মাসুদমামাকে পারলে ধরে মারেন আম্মা, “তোরে আমার ভাই পরিচয় দিতে লজ্জা লাগতেছে, ছোটলোক এই শিক্ষা দিছি তোরে?” নওশাদমামাও মার পক্ষ নিয়ে বার বার মাসুদমামাকেই দোষ দেয়, “আমি অনেক বার নিষেধ করছি আপা।”

তারপর আমার চোখে উটকো একটা ছবি এসে আটকে ছিলোঅনেকদিন। কল্পনারসকল জাল প্যাঁচ লাগা সুতার মতো, সুচরিতা শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে লুটিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করছে টিনের থালা হাতে,তার কোলে সেই স্তনে ঝুলে থাকা অবোধ মেয়েটা,সুচরিতার মাথায় জটা, অনেকদিন চিরুনি পড়েনা। কোলের মেয়েটার খালি গা, নাকে সিকনি… এ ছবি আমি যে কোথায় পেয়েছি! ওই যে সুচরিতা বলেছিলো, ভিক্ষা করে খেতে হবে।

গভীর রাতে আবার ঘুম ভেঙে গেলো। ‘নূরবানু নূরবানু’। আজ আর পরদিনের অপেক্ষা না করেঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি।হাঁটতে হাঁটতে বাড়িটার সামনে, ঝোপের আড়ালে সংকীর্ণ একটা প্রবেশদ্বার, সেখান থেকেই ডাকলাম ‘নূরবানু নূরবানু’। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সের একটা মেয়ে দরজা খুলে দিলো।আমি ভেতরে ঢুকলাম। ঘরময় থমকে থাকা বিষন্নতা, এ ঘরের মানুষগুলোর যেন কোন কাজ নেই, ভবিষ্যতের দিকে যাবার তাড়া নেই। ঘরের শ্যাওলা পড়া দেয়াল, দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা জানালার পাট সর্বত্র জীবনের দুর্বহ ভার। যেন এ জীবন না থাকলেই বাঁচে তারা।ভেতরে পান চিবুচ্ছে এক মহিলা, আর পাশে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। নওশাদমামা। আমার চিনতে একটুও ভুল হয়না।নওশাদমামা আমাকে দেখে একটুও চমকালেন না।“ও মজনু তোর মাসুদমামা আজকে ফোন দিয়েছিল, অনেক সময় কথা হয়েছে।”নওশাদ মামা যেন জানতেন আমি এখন এখানে আসবো।আফসোস করলেনআম্মার জন্য। বিছানায় পড়ার আগে প্রতিদিন সুচরিতাকে দেখতে আসতেন আম্মা! মহিলাটি কুলুমচি তুলে পানের পিক ফেলে, কেমন আকণ্ঠ মাতৃত্বের তৃষ্ণায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে পলকহীন, “বাবা মজনু”, তার গলা ধরে আসে, “আপা কেমন আছে বাবা?” আমি উত্তর দেয়ার আগে আঁচলের খুঁটে চোখ মুছেন তিনি,“আমারে একলা রাইখা যাইতেই পারেন না আপা।”নওশাদমামা চোখেমুখে কৌতুক মেখে জিজ্ঞেস করেন, “চিনতে পারসসুচরিতারে? তুই তো প্রতিদিন কার্নিভালের মাঠে ঘুরাঘুরি করতি! নূরবানুর জন্য খাবার নিয়ে গেলে সুচরিতা বলতো প্রতিদিন।”সুচরিতা আবার আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে, “নূরবানুরে কি যে ভালোবাসতো আপা।মাছ, মাংস যা রানতো সবই পাঠাইতো বাটি ভরে।” প্রসঙ্গ পাল্টে পরক্ষণেই জানতে চান নওশাদমামা, “কী চাকরি করস তুই? কাইলও তো তোরে দেখলাম কার্নিভাল মাঠের সুপার মার্কেটের সামনেহা কইরা দাঁড়াইয়া আছস।”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *