short-story-onu-paribar

অণু পরিবার
বৈশাখী ঠাকুর

ঘুম ভেঙেই মাথা গরম হয়ে গেল ওমের। ভেবেছিল অভ্যাসমত আদর আহ্লাদ করে মায়ের গলা জড়িয়ে উঠবে, তা না। বাবা এলেই যত ঝক্কি পোহাতে হয় ওমকে। মাকেও সাত তাড়াতাড়ি উঠে ফাই ফরমাশ খাটতে হয়। ওম আর তার মায়ের এক নিশ্ছিদ্র শান্তির সহাবস্থানে ব্যাঘাত ঘটে বাবার আগমনে। অন্য সময় হলে বেলা সাতটা অবধি ঘুমোয় ওম ছুটির দিনে। মা ছ’টা নাগাদ উঠে সব জানলা খুলে পর্দাটা টেনে দেয় যাতে ওমের মুখে রোদটা এসে না পড়ে, সে আরও ঘণ্টাখানেক নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। কপালের থেকে চুলির গুছি সরিয়ে দেয়। আস্তে করে মায়ের হাতটা কপাল থেকে ওমের গালে নেমে আসে। আলতো করে একটা চুমু খায় কপালে। তার পর অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে মিনিট খানেক। আধো ঘুম আধো জাগরণে ওম সেটা অনুভব করতে পারে। কিন্তু এখন উঠেই মাকে আগে বাবার জন্য লিকার চা করে বেড টি দিতে হবে। দুজনে এখন বিছানায় বসে খোশ গল্পও জুড়বে – হাসি ঠাট্টা হবে সে কতক্ষণ ধরে! এমন ভাব করবে যেন ওমের অস্তিত্বই নেই এ বাড়িতে। খানিক বাদে বাবা বাজার করতে গেলে মায়ের হুঁশ হবে যে তার একটা ছেলে আছে আর সে পাশের ঘরে শুয়ে আছে। ঘাপটি মেরে আর কতক্ষণই বা শোওয়া যায়। অন্য সময় হলে অনেক আগেই তার ঘরে ঢুকে সূর্যের আলো যেন না পড়ে তার ঘুমন্ত মুখে তাই পর্দা টেনে ব্যবস্থা করে যেত! মাথায় থাকত যে ছেলের মুখে রোদ পড়লে ছেলেটার অসুবিধে হবে, ঘুম ভেঙে যাবে। কিন্তু বাবা এলে ওমের খাতির একেবারেই কমে যায়। তখন মায়ের জীবন জুড়ে যেন বাবাই শুধু! ওম একটু শুয়ে থাকল এই আশায় যে মা এসে বুঝি দুঃখ প্রকাশ করবে যে আসতে পারেনি আগে, ওমের বুঝি অসুবিধে হল! কিন্তু সে গুড়ে বালি। মা কেবল একটা আলগোছে হাঁক দিল… “কই রে ওম উঠবি না নাকি? কত বেলা হয়ে গেল বল তো!” ওম বুঝল আজ আর শুয়ে থেকে লাভ নেই। তবু খানিক না শোনার ভান করে মটকা মেরে পড়ে রইল। কিন্তু কোথায় কী! মায়ের তো পাত্তাই নেই। দিব্ব্যি ময়দা মেখে বাবার জন্য সাত সকালেই লুচি বেলতে বসে গেল। কতদিন সকালে ওম লুচি খাওয়ার বায়না করে। মা তখন কিন্তু নানা অছিলায় কাটিয়ে দিয়ে ঠিক সেই রাতেই লুচি আলুরদম করে দেয়। জলখাবারে করে দিতেই চায় না আর এখন দেখ! সাত সকালেই কত না উদ্যম নিয়ে লুচি বানাতে বসে গেছে! ভীষণ রাগ হচ্ছিল ওমের। আর শুয়ে থাকতেও পারছিল না। লুচি আর হিং দিয়ে আলুর তরকারির ঘ্রাণ তার নাকে আসছিল। খিদেটাও চাগিয়ে উঠেছে বেশ ভালই। তার সাথে সারারাত ঘুমের পর বেজায় হিসিও পেয়ে গেছে। অগত্যা গাত্রোত্থান করতেই হল।

ততক্ষণে বাবা বাজার সেরে এসে জলখাবার খাওয়ার তোড়জোড় জুড়ে দিয়েছে। তরকারিটা দেখেই ওম বুঝতে পেরেছে – এ তরকারিতে বেশী করে লঙ্কা ঘেঁটে দেওয়া হয়েছে শুধু মাত্র বাবার সুবিধে এবং রসনা তৃপ্তির জন্য। আরও মেজাজটা বিগড়ে গেল। ওম এবার খাবে কী দিয়ে? এত ঝাল তরকারি যে ওম খেতে পারে না তা তো মা জানেই… তবুও! এবার নিশ্চয়ই অত্যন্ত মোলা য়েম স্বরে মা বলবে, “নে বাবু আজকের দিনটা একটু চিনি দিয়ে খেয়ে নে! সোনা ছেলে আমার! মানিক আমার!”

না, ওম মোটেই চিনি দিয়ে খাবে না। সেও মাকে মনে করিয়ে দেবে সাদা রিফাইন্ড সুগারের যা যা বাজে গুণ আছে আর তার মা অহরহ তাকে দু’বেলা সে কথা মনে করিয়ে দেয় সেটা যেন এখন মা বিলকুল ভুলে না যায়। তবে এত কিছুর আর দরকার পড়লো না কারণ তাকে লুচি দেবার সময় সে বুঝতে পারল এক বাটি তরকারি লঙ্কা ঘেঁটে দেবার আগে মা তুলে রেখেছে। ঠিক যেন বাচ্চাদের ভোলাতে খেলতে নেওয়ার সময় ‘দুধভাত’ বলে দলে নেওয়া। মনে মনে ভীষণ রাগ হল ওমের। অন্য দিনের মত গরম লুচির স্বাদটা যেন সে কিছুতেই পেল না।

খাবার খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সম্বিত পাল অর্থাৎ ওমের বাবা তাকে তার উপহারটা বের করে দিল। এবার ওমের সব রাগ মুহূর্তে গলে জল। তার বহু আকাঙ্খিত রিমোট কন্ট্রোল কার! কি সুন্দর লাল টুকটুকে গাড়িটা। কালো কালো চাকা আর কালো বর্ডারের জন্য যেন আরও বেশী উজ্জ্বল লাগছে দেখতে। এতদিন এমন একটা মহার্ঘ গাড়ির কথাই সে মনে মনে কল্পনা করত। তার প্রায় সব বন্ধুদেরই আছে। আর আজ সেটা তারও হাতের মুঠোয়! মনটা এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল। সে হামলে পরে গাড়িটা নিয়ে খেলতে শুরু করে দিল। দেখেশুনে বেশ ভালই চালাতে পারছিল নিজে। এ ঘর ও ঘর পাঠাচ্ছে আবার নিজেই এক জায়গায় বসে সেটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে। খাটের তলা, আলমারির তলায় ঢুকে গেলেও বের করার অসুবিধে নেই। এই এক মজা। শুধু হাতে করে রিমোট কনট্রোলটা চালাতে জানলেই হল। বেশ মেতে উঠেছে ওম। চালাতে চালাতে এক সময় সেটা বাবা মায়ের ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। কোন অসতর্ক মুহূর্তে বুঝি গাড়িটা তাদের মাঝে গিয়ে উপস্থিত হয়ে থাকবে, বিস্ফোরক মন্তব্যে ফেটে পড়ল বাবা! যত না তাকে বকলো তার চেয়ে ঢের বেশী কথা শোনাল মাকে, “দেখো দেখো তোমার ছেলের কান্ড দেখো! কী তৈরি করেছ তুমি তোমার ছেলেকে? কোন বুদ্ধিসুদ্ধি নেই! এত বয়স হয়ে গেল এখনও কোন সেন্স নেই? কী হবে এর ভবিষ্যতে বলতে পারো? নক না করে এত বড় ছেলে ঘরে ঢুকে এল? মিনিমাম সেন্সটুকু নেই? সিমপ্লি ডিসগাস্টিং! সহবত শেখাও। ম্যানারস শেখাও ছেলেকে! সারাজীবন কি ছেলেকে আঁচলের তলায় রাখবে নাকি? সাবলম্বী হতে শেখাও। দশ বছর বয়স হয়ে গেল। ছোট ছোট ন্যাকা ন্যাকা হয়ে থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে। সময় থাকতে থাকতে একে শোধরানোর ব্যবস্থা কর বলে দিচ্ছি কিন্তু তোমাকে!”

ওম দেখল তার মায়ের মুখটাও শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। বেগতিক দেখে ওম তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “আমি একদম বুঝতে পারিনি যে এটা দুম করে এই ঘরে ঢুকে যাবে! সত্যি বলছি মা।” গলাটা প্রায় ধরে এল ওমের।

“বুঝতে পারিনি! বুঝতে পারিনি আবার কি? গাড়ি কোনদিকে যাবে সেটা কন্ট্রোল করার জন্যই তো রিমোট কন্ট্রোলটা হাতে দেওয়া! কচি খোকা হয়ে আর কতদিন থাকবে?”

বাবা মুহূর্তে আরও কিছু বাক্যবাণ তাকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে দিল। কিন্তু ওম সত্যিই ইচ্ছে করে করেনি। সে মায়ের থেকে সমর্থন পাওয়ার জন্য মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “সত্যি গো মা। একদম নতুন গাড়ি তো। অতটাও ভাল করে হ্যান্ডেল করতে শিখিনি।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি কিছুই শেখোনি! শুধু আমার মাথা খেতে শিখেছ। উফ! আমাকে দু’দন্ড শান্তি দে তো! যা সরে যা আমার চোখের সামনে থেকে! আর পারছি না যেন আমি!”

বুক ফেটে যাচ্ছিল ওমের। বহু কষ্টে সে কান্নাটাকে সংবরণ করেছিল। কেউ তাকে বোঝে না। কেউ না। কেউ তাকে ভালবাসে না। বুকের ভেতর যেন কে হাতুড়ি পিটছিল। বাবা-মা দুজনেই তার বিরুদ্ধে। পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছিল। এক অদ্ভুত ভয়ের বশবর্তী হয়ে অনেক কষ্টে ঢোক গিলে ম্রিয়মান শব্দে বলল, “আচ্ছা আমি সরেই যাচ্ছি। আমি বরঞ্চ এইবেলা চান করতে যাই।” এই অছিলায় তাদের দুজনের সামনে থেকে সরে যাওয়াও হবে আর এখন তো এই বাথরুমই একমাত্র জায়গা যেখানে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া যেতে পারে।

একটা সূত্রের অপেক্ষায় বুঝি ছিল। আরও যেন ফেটে পড়ল মা।

“জাহান্নামে যাও। যা পারো করো। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও!”

“তুমি রাগ করেছ মা?”

“যা দূর হ আমার সামনে থেকে! বলছি যে শুনতে পাচ্ছিস না” বলে তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে মা বেরিয়ে গেল।
ওম এত কিছুর জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না। বড্ড বুকে বাজলো তার। হু হু করে উঠল বুকের ভেতরটা। ঊষর মরুভূমিতে যেন সে দাঁড়িয়ে আছে! সে কী এমন করেছে যে তার সাথে সবাই এমন করছে? কই সে তো মুখে মুখে তর্ক করেনি! ভুলও স্বীকার করে নিয়েছে তৎক্ষণাৎ। সামনে থেকে সরে যাবার জন্যই তো চানে যেতে চেয়েছে! মিথ্যে কথা বলেনি! কোন দামী জিনিস ভাঙচুর করেনি! পড়াশোনায় অবহেলা করেনি। নিয়মিত আঁকতে যায়, ক্যারাটে করে, সাঁতারে যায়। তাও খুশী নয় তার বাড়ির লোকেরা। ওম নিজের অপরাধটা বুঝতে পারল না। সে বাথরুমে গিয়ে জোরে কল খুলে দিয়ে খানিক হাউহাউ করে কাঁদল। সে চোখে যেন অন্ধকার দেখছিল। তার নিজের বাড়িতেই সে অনাকাঙ্ক্ষিত। অনাহূত। বাথরুম খুলে বেরোতেই ইচ্ছে করছিল না তার। আবার বেশীক্ষণ বাথরুমে সময় কাটালে সেই নিয়েও হয়তো হইচই বাধিয়ে দেবে। তাই সে জোরে জোরে সাবান ঘষে স্নান করে বেরিয়ে নিজের মত খুঁজে জামাকাপড় পরে নিল। অন্য দিন মা তাকে তার গামছা জামা প্যান্ট গুছিয়ে বাথরুমে দিয়ে আসে। আজ যে সেটা হবে না তা সে ভালই জানে। চুপচাপ জামা প্যান্ট পরে বেরিয়ে নিজেই আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়ে তার ঘরের একটা বক্স জানলায় গিয়ে বসে সারাক্ষণ বাইরে চেয়ে রইল। কেবল নোনা জলে তার চোখের কোল দুটো ভিজে যাচ্ছিল। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল ভেতরটা। বড্ড চাপ লাগছিল বুকে। কেউ বোঝে না। কেউ তার দিকটা একবারও ভেবে দেখল না। একবার তার জায়গায় নিজেদের বসিয়ে দেখুক দেখি! আসলে কেউ তাকে ভালবাসে না। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও তার থাকতে ইচ্ছে করছিল না। তার মনে হচ্ছিল এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে সে চলে যাবে। থাকবে না সে এখানে। এই চিন্তাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল অবিরাম। দুর্দান্ত এক আক্রোশে ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছিল তার।

জানলায় বসে বসেই রান্নার তোড়জোড়ের আওয়াজ কানে আসছিল ওমের। বাবা এলেই যেন মোচ্ছব লেগে যায় বাড়িতে। ফ্রায়েড রাইস আর মাংস হচ্ছে। তেল মশলা কষানোর যে সুবাস হাওয়ায় ভাসছিল তাতেই সে টের পাচ্ছিল। বাবার তো ফ্রায়েড রাইস খুব একটা পছন্দের নয়। তাহলে কি তার জন্যেই? সে হোক। তাও সে মোটেই বিগলিত হবে না। বাবা দু’চারবার এই ঘরে এসে ঘুরঘুর করে গেল। ওম ফিরেও তাকায়নি। বয়েই গেছে তার। সে শুধু মায়ের আচরণ খেয়াল করে যাচ্ছে। কি পর পর ভাব! অন্য সময় সারাদিন ওম ওম করে বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়। তাকে ঘিরেই মায়ের দিন আবর্তিত হতে থাকে। আর এখন! জানলা দিয়ে একটা অজানা পাখি দেখলেও তাকে ডেকে দেখায়। তাদের বাড়ির পাশের পুকুরটায় পানকৌড়ি যখন ডুব দিয়ে মাছ ধরে মা আর ওম সেটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। কত সময় ছবি তোলে মুঠোফোনে। ভিডিও করে। ওম জানে আজ সকালের দিকে পানকৌড়িটা মাছ ধরছিল তখন বাবাকে সোৎসাহে সেটা ডেকে দেখাল মা। তাও ওম কিছু মনে করেনি কারণ সে তখন বিছানায় শুয়ে গড়িমসি করছিল। তাই বলে এত দুর্ব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না। এত দ্রুত এরকম পরিবর্তন! ওম ঠিক করল সেও এর প্রতিশোধ নেবে। সেও মাকে পাত্তা দেবে না। বাবার সাথেই ভাব জমাবে। তাহলেই মা টের পাবে কেমন মজা। হ্যাঁ, যেমন কর্ম তেমন ফল। ঠিক এটাই করবে ওম।

বাবারও বুঝি কড়া বকুনি দিয়ে অনুতাপ হয়েছে। নিজেই এসে বলল, “আয় একটা মাংস টেস্ট করি ওম। দেখি মা কেমন নামিয়েছে মাংসটা।” মা যে রান্নাটা জমিয়ে করেছে তা গন্ধতেই মালুম হচ্ছিল। তার ঘাড়ে হাত দিয়ে বাবাও জানলায় তার পাশে এসে বসল। যদিও ভাল করে আঁটছিল না—ওম প্রায় চেপেই যাচ্ছিল। একটু সরে জায়গা করে দিতেই হল। মাংসর রং আর গন্ধটা এত লোভনীয় হয়েছিল যে সে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারল না। একটা মাংস মুখে পুরে দিয়ে তার স্বর্গীয় স্বাদে তার মনটা একটু হলেও যেন ঠিক হল।
তবে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ওম মায়ের ধারে কাছে ঘেঁষল না। নিজেই সোফার ওপর আধশোওয়া হয়ে টিভি খুলে বসল। দুপুরে টিভি খুললে সে সাধারণত বকুনি খায়। কেন এই সময় সে একটু অঙ্ক করছে না বা আঁকার হোমটাস্ক করে এগিয়ে রাখছে না! কিন্তু কোন জাদুবলে কে জানে ওম আগেই টের পেয়েছে আজ তাকে কেউ কিছু বলবে না। দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে বাবা মা দুপুরে ঘুমোতে গেল। গম্ভীরভাবে আড় চোখে চেয়ে দেখল ওম। কোন উচ্চবাচ্য করল না। মনে মনে ভাবল একটা গাড়ি ঘরে ঢুকে গেছিল বলে যা সীন ক্রিয়েট করল দুজনে। ওমের ভারী বয়েই গেছে ওদের সাথে ভাব জমাতে। তার কি আত্মমর্যাদা নেই নাকি! সে একদম নিজের মত থাকবে। খুব প্রয়োজন না হলে কারোর সাথে কথাই বলবে না। এবার শুধু মজা দেখবে।

মায়ের সাথে আগে তার কত কথা হত। কত গল্প হত। অলস দুপুরে মা তাকে নানারকম গল্প পড়ে শোনাত। বাবা থাকলে তো সেটা হতই না। তারপর বাবা চলে যাবার পরও কিরকম তাল কেটে গেল। তারপরেও মা পাশ ফিরে চুপ করে শুয়ে থাকত। একটুতেই বিরক্ত হতো, হাঁপাতো, কেমন খিটখিট করত। এমনিতেই ওম আগের মত মায়ের পায়ে পায়ে আর অত ঘুরে বেড়ায় না। নিজে সাবলম্বী হবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু দরকারে তার এখনও মাকে লাগেই। মা কি তা বোঝে না? মা এত পাল্টে গেল কেন? অভিমানে ভরে যায় ওমের মন। আবার মুড ঠিক হলে মা তাকে আদর করলে সে আবার জীবনের পুরনো ছন্দে ফিরে আসে। তবে সে খেয়াল করেছে মা যেন একটু দূরে দূরে থাকারই চেষ্টা করে।
কিছুদিন বাদে ইশকুলটা খুলতে ওম একটু শান্তি পেল। ইতিমধ্যে অবশ্য বাবাও চলে গিয়েছে কর্মস্থলে। মাঝে মাঝে ফোন করে তাকে চায়। খোঁজখবর নেয়। মাকে দেখেশুনে রাখতে বলে। এমনি দিনে সকালে ইস্কুল চলে যায় ওম। ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। মাসতিনেক ইস্কুল করার পর তার মনে হল মায়ের যেন শরীরটা সত্যিই খারাপ। একটুতেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। ঘুমোয় আগের থেকে অনেক বেশী। চলাফেরার গতিও কেমন কমে গেছে। যে দ্রুততার সাথে কাজ করত তাতেও যেন ঢিলেমি এসেছে ভালই। চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। চোখ দুটোও কেমন কোটরে চলে গেছে একেবারে। চলতে ফিরতে কেবলই হাঁপিয়ে ওঠে। কোন কাজেকর্মে আর তেমন মন নেই। আগের মত আর তাকে পড়া ধরে না। নিত্যনতুন খাবার বানিয়ে দেয় না। ওই কেক, মিষ্টি আর ক্রিম বিস্কুট টিফিন নিতে নিতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। পাছে বকুনি খায় তাই চুপ করে থাকে। সেদিন মায়ের নিজেরই বোধহয় মনে হয়েছিল তাই নিজে থেকেই টাকা দিয়েছিল ক্যানটিনে খাবার জন্য। আজকাল প্রায়ই মা তাকে টাকা দিয়ে দেয়। আর টিফিন দেয় না বানিয়ে। সকালে উঠতেও যেন মায়ের কষ্ট হয়। ইতিমধ্যে পাড়ায় বেরোলে সবাই মায়ের শরীরের খবর নেয়। সাবধানে থাকতে বলে। বাবা এলেও মায়ের যেন একটু বেশী বেশী করেই খেয়াল রাখে। মায়ের শরীর ভাল না দেখে ওমও বেশী ঘাঁটায় না আর মাকে। দুপুরে আগে যে মা টানা গল্পের বই পড়তো সে মা এখন নাক ডেকে ঘুমোয়।
বাবা এলেও ইদানিং দেখেছে ওম মায়ের তেমন হেলদোল নেই। নিজের শরীর নিয়ে বেশ নাজেহাল মা। তারপর আজকাল প্রায় প্রায় ডাক্তার দেখাতেও যায়। একটা কিছু অবশ্য সন্দেহ হচ্ছিল ওমের। কিছুদিন বাদে মায়ের পেটটা ফুলে থাকা দেখে সে একেবারে নিশ্চিত হল।
অতঃপর বাবাও ট্রান্সফার নিয়ে পাকাপাকি ভাবে তাদের কাছে চলে এল। নিজের মত করে আস্তে আস্তে মানিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছিল ওম কিন্তু মুশকিল হল পুঁচকেটা জন্মাবার পর। মাকে আর সে একদমই কাছে পায় না। বেশিরভাগ সময় তো বাবাই কাছেফিরে ঘুরে বেড়াত। আবার এখন ছোটটা জুটেছে। তার ভাইকে অনেকটাই তার মত দেখতে হয়েছে। বাড়িতে যেই আসে সেই ভাইকে নিয়ে মাতামাতি করে।

“ওমা! দেখ দেখ কিরকম বড় বড় চোখ করে দেখছে। তোমাকে মনে হয় পছন্দ হয়েছে জান।”

“ছোটরা আসলে ভাল আর খারাপের পার্থক্যটা বুঝতে পারে।”

তুমুল হাসির রোল। তারপরে অন্য অতিথি এলে, “রাতে জ্বালায় নাকি? আসলে এখন শীতকাল তো কোলে ঘুমিয়ে আরাম পায়।”

“তা বুস্টার ডোজগুলো ঠিক ঠিক দিচ্ছিস তো। ওগুলো খুব ইম্পরট্যান্ট বুঝলি। ওগুলো যেন ঘুণাক্ষরেও ভুলিস না।”

“কৌটোর দুধ দিস নাকি? একদম দিবি না। মায়ের দুধ যতদিন খাবে ততদিন পেটের সমস্যা হবে না, ইমিউনিটি পাওয়ার বাড়বে। ফিগার নষ্ট হবে ভেবে যেন তোলা দুধ খাওয়াতে যাস না, বাচ্চারই ক্ষতি হবে।”
এরকম অতিথি সমাগম হতেই থাকে তাদের বাড়িতে আর অজস্র জ্ঞান বর্ষণ হয় অনবরত তাদের বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর। যারাই আসে তারাই ভাইয়ের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। তার কথা আর কেউ মাথায় রাখেই না। কেউ কেউ তো আবার তাকেও ডেকে বলে, “তুই কিন্তু এখন দাদা হয়ে গেছিস। তোর কিন্তু এখন অনেক দায়িত্ব—মনে রাখিস।”

বাবা মা ভাইয়ের একটা স্বতন্ত্র জগত তৈরি হয়েছে। সে এখন সম্পূর্ণ ব্রাত্য। সবার হাবভাব দেখলে মনে হবে ওমের যেন রাতারাতি আঠারো বছর বয়স হয়ে গেছে। ইস্কুল থাকলে তার তেমন অসুবিধে হয় না। ইস্কুল যায় আসে। তারপর ক্যারাটে, সাঁতার থাকে। আজকাল ঋতব্রতর মা তাকে আর ঋতব্রতকে সাঁতার করাতে নিয়ে যায়—নিয়ে আসে। তারপর এসে হাত পা ধুয়ে একটু খেতে না খেতেই তাকে আন্টি পড়াতে আসে। আন্টি গেলে ইস্কুলের হোমটাস্ক করে সে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে অচিরে। সপ্তাহের দিনগুলো এইরকম তুমুল ব্যস্ততায় তার কেটে যায়। কিন্তু ছুটির দিন এলেই হয় মুশকিল।

সত্যি কথা বলতে কি ভাইটাকেও তার সহ্য হয় না মোটে। তার সব পুরনো খেলনাগুলো এগিয়ে এগিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এদিকে সে জুলজুল করে ক্যাবলার মত চেয়ে থাকে। কিচ্ছুটি তো বোঝে না। সময়ের জ্ঞান নেই থেকে থেকেই কেবল কেঁদে ওঠে। হিসি করে-পটি করে আবার সাদা সাদা কি সব বমিও তোলে। মা আবার বলে দই তুলছে। যত সব আদ্যিখেতা! বমিকে যেন বমি বলা যাবে না। একটা স্পেশাল নাম দেওয়া হয়েছে, দই! খুঁজে খুঁজে তাঁর সব ছোট জামা প্যান্ট বের করা হয়েছে আর ভাইকে বহাল তবিয়েতে পরানোও হচ্ছে। কই ওম তো কিছু বলে নি। কিন্তু সেদিন যেমনি ও ভাইয়ের একটা গাড়িতে হাত দিল বাবা একেবারে রে রে করে উঠল। ওর নাকি নোংরা হাত! ভাইয়ের ইনফেকশান হয়ে যেতে পারে। রাগের চোটে ওম ছুঁড়ে খেলনাটা ভেঙেও দিয়েছিল। কেমন তো একটা দেখতে ওই এক রত্তি ছেলে। নড়তেও পারে না, চড়তেও পারে না। কথাও বলতে পারে না। বেশীরভাগ সময় পড়ে পড়ে ঘুমোয়। তাকে নিয়ে আবার এত মাতামাতি। সে যেন বাড়ির কেউ নয়। বাড়িটা যেন শত্রুপুরী হয়ে উঠেছে। একেবারে অসহ্য!

সেদিন ছুটির দিন দুপুরবেলায় বাবা মা ভাই ঘুমোতে গেছে একসাথে। ওমও সুযোগ বুঝে খানিক টিভি চালিয়ে নিজের প্রিয় কার্টুনের অনুষ্ঠান দেখে নিয়েছে। এইসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ওমও এখন শিখে গেছে পুরোদস্তুর। তারপর ভাল মানুষের মত নিজের ঘরে এসে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। শুতে না শুতেই সে শুনতে পেল ভাই চিল চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। ব্যস! মুহূর্তে সবার ঘুমের দফারফা। হেব্বি মজা হয়েছে ওমের। আচমকা মনে হল ওমের, ভাইটা কিন্তু বেশ ভালই জব্দ করেছে বাবা-মাকে। একদম নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে! সারাদিন সবাই ওর পেছনে চরকির মত ঘুরছে। অতটুকু ছেলেকে দেখেশুনে রাখতেই হবে। অতএব কারোর আর তেমন অবসর সময় নেই। নাও এবার বোঝো ঠ্যালা! ভাবতেই পেট গুলিয়ে হাসি পেল ওমের। ওম খেয়াল করে দেখেছে ভাই সাধারণত সকালের দিকেই লম্বা ঘুমটা দেয়। অঘোরে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। আবার ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে হাসে। মাঝে মাঝে কাঁদে। মা দেখে বলে, “দেয়ালা করছে”। কত যে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শোনে ওম তার ইয়ত্তা নেই। গা ভর্তি র‍্যাশ বেরোলে বলে “মাসিপিসী হয়েছে”। হাঁচলে কাশলে বলে “জীবঃ”। ভগবান বুদ্ধের ডাক্তার জীবককে নাকি স্মরণ করা হচ্ছে। ওম তো শুনে আশ্চর্য হয়ে গেছিল। সেটা যে কেন তার আর সদুত্তর পায় না। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কেন যে এই অদ্ভুত শব্দভান্ডার কে জানে!

তবে ভাই ঘুমোলে মা সেই ফাঁকে বাড়ির সব কাজ সারে নিশ্চিন্তে। গতকাল রাতেও পুঁচকেটা নাকি ভাল করে ঘুমোয়নি। এক এক সময় রাতে বাথরুম করতে উঠলে ওম শুনতে পায় ভাইয়ের গলা। সে এখন বড় হয়ে গেছে বলে তাকে শোওয়ার জন্য আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে। প্রথমে একটু মনখারাপ হয়েছিল ওমের কিন্তু এখন মনে হয় এক দিক দিয়ে বেঁচে গেছে। সারাক্ষণ কানের কাছে ঐ প্যানপ্যানির রেকর্ড কাঁহাতক ভাল লাগে! কিন্তু মুশকিল হল পুঁচকেটা তো দিনে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নিল, কিন্তু মা! দুপুরটা একটু না বিশ্রাম পেলে, না ঘুমোলে কী করে পারবে? দুপুরে বাবাকে তাই সামলানোর দায়িত্ব নিতে হয়েছে আর অপ্রত্যাশিত ভাবে মা ওমের পাশে শুতে এসেছে। ওম তো একেবারে অবাক! বুকের ভেতর দিম দিম দ্রিমি। ব্যাপারটা কী? কী হল কী মায়ের? সে আলগোছে একটু সাইড করে মাকে শোওয়ার জায়গা করে দিল। ক…তদিন বাদে এত কাছ থেকে মায়ের গায়ের গন্ধ পেল আবার! নাক ভরে শ্বাস নিল সে। মা তাকে কাছে টেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে গায়ে হাত দিয়ে ঘুমোল। মনটা এক নির্মল আনন্দে ভরে গেল ওমের। শেষ কবে মাকে জড়িয়ে শুয়েছিল মনে করতে পারল না সে। আবেশে চোখটা বুজে এল তার।

তারপর দিন ওম ভাইয়ের সাথে অনেকক্ষণ খেলা করল। সে বুঝতে পেরেছে ভাই-ই তার একমাত্র সমব্যথী। ওই একরত্তি পুঁচকেটাই একমাত্র পারে বাবা মাকে জব্দ করতে। ভাইকে এখন তাই ওম ভীষণ ভীষণ ভালবাসে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *