রেহান কৌশিক
“ইয়াক বুঝি কষ্ট পাবে না?”
“কলকাতায় তুমি যখন টানা রিকশায় ওঠো, তখন রিকশাপুলার কষ্ট পায়?”
মেয়ের জবাবে থতমত সায়নদীপ।
আমতা আমতা করে বলল, “সে তো অনেক আগে। এখন তো আর উঠি না।”
বাবা-মেয়ের টানাপোড়েনের মাঝে রত্নদীপা নেই। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অন্যমনষ্ক। কাছেদূরের পাহাড়ে ধূসর পাথরের গায়ে জমে আছে বরফ। যেন নিশ্চল পাথরের গাছে ফুটে আছে স্তব্ধ তুষারের ফুল। এই মুহূর্তে রত্নদীপাও যেন তুষারের ফুলের মতোই স্তব্ধ, উদাসীন।
তড়িঘড়ি কুশল বলল, “সায়ন, তিতলি যখন আবদার করছে, ওকে ইয়াকে চড়িয়ে আনি। আপনারা বসুন।”
“আরে না না…”
এলা সায়নদীপকে বলল, “এত সংকোচ করবেন না তো। ওরা যাক না। ততক্ষণে আমরা বরং আরও এক মগ করে কফি নিই।”
আলপাইন ক্যাফেটোরিয়াটা চমৎকার। কেবল-কারে এখান থেকে আরও দু’হাজার ফুট উঁচুতে পাহাড়ের অন্যপ্রান্তে যাওয়া যায়। নীচে ছাঙ্গু লেক। বরফের সাদা মাঠ। এই মার্চেও জমে আছে।
তিতলিকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এল কুশল। হ্রদের পাশে বেশ কয়েকটা ইয়াক নরম বরফে পা ডুবিয়ে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কালো লোমশ ইয়াকগুলোর শিংয়ে লাল ফিতে জড়ানো।
লেকের পাশে পাহাড়ের ঢালে ইয়াক হাঁটছে। ইয়াকের পিঠে চড়ে তিতলি খুশিতে উজ্জ্বল। সমতলের মানুষজনের মনে পাহাড়ি সকাল একটা রোমান্টিক ভাব এনে দেয়। বিশেষত, সুউচ্চ পাইনের ফাঁক গলে সোনালি রোদের টুকরো যখন কুয়াশাভেজা পাথরে-মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অথবা, চতুর্পাশ সাদা হয়ে থাকা বরফের দেশে মেঘেদের ফাঁকি দিয়ে ভিনদেশি পাখির মতো রোদ্দুর যখন ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে হাজির হয়।
রিং হলো মোবাইলে। কুশল দেখল স্ক্রিনে ক্লায়েন্টের নাম্বার। কানে নিয়ে বলল, “সতর্ক আছি। এ-পর্যন্ত প্ল্যান মতোই সব এগোচ্ছে। দুহাজার একের ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচটা মনে আছে?”
“কোথায়?”
“ইডেনে। সৌরভ ক্যাপটেন। মনে পড়ছে?”
“হ্যাঁ।”
“সিচ্যুয়েশনটা ওরকম।”
“সারভাইভ কি করবে?”
“হোপ সো। ম্যাচটায় অস্ট্রেলিয়া টস জিতে ব্যাট নিল। চারশো পঁয়তাল্লিশ করল। ইন্ডিয়া একশো একাত্তরে বান্ডিল। স্টিভ ওয়া ইন্ডিয়াকে ফলো অনে পাঠাল। ইন্ডিয়া সেকেন্ড ইনিংসে ছ’শো উনপঞ্চাশ। সৌরভ ডিক্লেয়ার করল।”
“হুম। লিড তিনশো পঁচাত্তর।”
“রাইট। এবার যদি হরভজনের মতো অলআউট অ্যাটাকিংয়ে যেতে পারি, তাহলে…”
“দেখুন, কী হয়। বেস্ট অফ লাক।”
সমুদ্রতল থেকে সাড়ে বারোহাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়ি আবহাওয়া ছেনালি করা রাজনৈতিক নেতাদের মতো। অলীক, অনিশ্চিত। এক্ষুনি রোদ-ঝলমলে, পরক্ষণেই কুয়াশায় অন্ধকার।
এবং এটাই হল। চারপাশের ঝলমলে ভাবটা দ্রুত ফিকে হয়ে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। ইয়াকের লাগাম টেনে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রেমজি।
বলল, “সাহাব, আগে বাড়না থোড়া মুশকিল হ্যায়। রুখনা পড়ে গা।”
তিব্বতি প্রৌঢ়ের ফর্সা কপালের বলিরেখাগুলো গভীর হয়ে উঠেছে। কুশল বলল, “পাহাড়ি লোক হয়েও ভয় পাচ্ছ! নাকি, আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই বলে ভয় দেখাচ্ছ?”
“ডর দিখানা হামারা কাম নেহি, সাহাব। হকিকতই কুচ এ্যাইসা হ্যায়।”
কুশল চুপ করে যায়। দেখল, সত্যিই কুয়াশা ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে চতুর্পাশ ঢেকে ফেলেছে। তারা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অথচ পরস্পরের মুখ ক্রমশ আবছা হয়ে উঠল।
প্রেমজি বলল, “পাহাড়িয়াঁ কা আপনা মিজাজ হোতা হ্যায়। আলগ আন্দাজ হোতা হ্যায়। ও কিসি কী নেহি শুনতে। বল-কী সভি কো উনকি ইচ্ছা কা পালন করনা হোতা হ্যায়।”
কয়েকমুহূর্ত আগেও যাকে ইয়াকের অতিসাধারণ কেয়ারটেকার ছাড়া কিছুই মনে হয়নি, সেই প্রেমজি তামাংয়ের কথায় ঝটকা লাগল কুশলের। ভালো করে প্রেমজির মুখটা দেখার চেষ্টা করল। কুয়াশার ভিতর দাঁড়ানো মানুষটার মুখ স্পষ্ট নয়। কুশল ভাবল – সম্পর্কও কি তাই? ওই পাহাড়ের মতো? নিজের সময়ে নিজের মর্জিতে চলে? আর, মানুষ তার পুতুলখেলার সুতোয় বাঁধা অসহায় পুতুল? আদালতের নির্দেশে সায়নদীপ ও রত্নদীপা যে বেড়াতে এসেছে, এতে কি সত্যিই পুরোনো সম্পর্কের রং ও সুগন্ধ ফিরবে? নাকি, ডিভোর্সের ব্যাপারে ওরা অনড় থাকবে?
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়াকের পিঠে বসে থেকে তিতলি বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। বলল, “আঙ্কল, আমি কি পাইনের জঙ্গলে যাব না?”
ইয়াকে চড়ে তিতলি দুই পাহাড়ের মাঝে কিছু পাইনগাছ দেখিয়ে বলেছিল, সে পাইনের জঙ্গলে যেতে চায়।
কুশল বলল, “হঠাৎ কুয়াশা এসেই তো সব ভণ্ডুল করে দিল।”
“কিন্তু আমাকে যে জঙ্গলে যেতেই হবে। নাহলে শেরখানের মুখোমুখি হব কী করে?” তিতলির গলায় মনখারাপের স্বর।
“মানে?” অবাক হল কুশল।
“জাঙ্গলবুক পড়োনি? আমি তো মোগলি, আমার শত্রু হল শেরখান। ওকে জঙ্গল থেকে তাড়াতেই হবে। দরকার হলে যুদ্ধ করব। ওর জন্য আমরা সবাই কষ্টে আছি।”
এবার কুশল বুঝতে পারল তিতলি রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের লেখা জাঙ্গলবুকের চরিত্রদের কথা বলছে।
বিস্মিত কুশল জিগ্যেস করল, “মোগলি শেরখানকে হার মানতে বাধ্য করেছিল, কিন্তু তুমি কি তোমার শেরখানকে তাড়িয়ে দিতে পারবে?”
“ডোন্ট ওরি, মোগলি সব পারে। ইয়াকের পিঠে দেখে আমাকে মোগলি বলে মনে হচ্ছে না?”
“তা হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা বলবে, মোগলি?”
“কী?”
“তুমি কি তোমার শেরখানকে চেনো?”
“চিনি তো। সুবীরেশ আঙ্কল। ওই আঙ্কলের জন্যই তো বাবা-মা ভালো নেই।”
তিতলির কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেল কুশল।
লিপ রিডিং, সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কি ও অরুণিমা সান্যাল
কিছু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছেদের ডালপালায় লেগে থাকা জলের ফোঁটা থমকে থেমে মাটিতে পড়ছে। এখন রোদ। বিকেলের রোদ তরল-সোনা। মহাত্মা গান্ধী মার্গের পরিচ্ছন্ন ও ভিজে-রাস্তা সোনালি রোদে ঝকমক করছে। পথচলতি মানুষজনকেও সোনালি-রোদ ধুয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ের ওপর প্রায় দেড় লাখ মানুষের গ্যাংটক যেন এক অদৃশ্য জাদুকরের ইশারায় মায়ানগর হয়ে উঠেছে!
হোটেলের ব্যালকনি থেকে অনেকক্ষণ ধরেই রত্নদীপার ওপর নজর রাখছে কুশল। হোটেলের সামনে, রাস্তার পাশে ওককাঠের নকশাদার বেঞ্চে বসে সে ফোনে কথা বলছিল। এখন চুপ করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজন দেখছে। ঠিক এইসময়ই ক্লায়েন্টের ফোন। রিসিভ করে কুশল দু-চারটে কথার পর বলল, “ওর কাছেই যাচ্ছি। এখন রাখি।”
কুশল হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এল। একদম রত্নদীপার সামনে গিয়ে মৃদু হেসে বলল, “মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ/উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক/ কল্পনার হাঁস সব – পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেলে পর/উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।”
রত্নদীপা অবাক। বলল, “জীবনানন্দ! রাইট?”
“রাইট।”
“একটা বিষয় আমাকে অবাক করে জানেন।”
“কী?”
“বাঙালি মাত্রেই জীবনের কোনও না কোনও সময় হয় কবিতা লেখে, নাহলে কবিতার প্রেমে পড়ে।”
“জগতের সব মানুষের হৃদপিণ্ডে দুটো অলিন্দ থাকে। ডান ও বাম। শুধু বাঙালিদের থাকে তিনটে। ডান, বাম এবং কবিতা। যে কোনও বাঙালির বুকে কান পাতলে লাবডুব শব্দের সঙ্গে আরও একটা শব্দ শোনা যায়। কবিতার শব্দ।”
“কিন্তু সব পুরুষই কি ফ্লার্ট করে?”
“তা জানি না। তবে আমি করি।” রত্নদীপার কথার উত্তর দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল কুশল।
রত্নদীপার মুখ মেঘলা হয়ে উঠল।
কুশল বলল, “বাট, আমি কিন্তু এখন ফ্লার্ট করিনি। ব্যালকনি থেকে আপনাকে দেখছিলাম। আপনি ফোনে কাউকে নিজের হতাশার কথা স্পষ্টভাবে জানাচ্ছিলেন। তারপর ফোন ছেড়ে বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন। আপনার বিষণ্ণ মুখ দেখে লাইনগুলো মাথায় এসেছিল। ভাবলাম, মুখোমুখি বলে আসি। তাই এলাম।”
“হোয়াট!” ভ্রু কোঁচকাল রত্নদীপা। তারপর বলল, “একজন ভদ্রমহিলাকে স্টক করা অপরাধ, তা জানেন?”
“জানি। কিন্তু সেই স্টকিং যদি মহৎ উদ্দেশ্যে হয়, তখন নিশ্চয় অপরাধ মাফ হয়ে যায়। যায় না?”
“মহৎ উদ্দেশ্য! কীরকম?”
“এই যে আপনি বলছিলেন – না রে, সম্ভব নয়। বিশ্বাসের সুতোয় অবিশ্বাসের গেরো পড়ে গেলে জীবনে তা আর খোলে না। আমার প্রতি সায়নের যদি আস্থাই না থাকে, তাহলে আর একসঙ্গে থাকব কেন?”
চমকে ওঠে রত্নদীপা। বলল, “আপনি ভয়ংকর লোক তো মশাই! আপনি কি আমার ফোন ট্যাপ করেছেন?”
“ওটা পুলিশের কাজ। আমার না।”
“তাহলে?” তীব্র উৎকণ্ঠা রত্নদীপার গলায়।
“সিম্পল। লিপ রিডিং।”
দিশেহারা দেখায় রত্নদীপাকে। গলায় অবিশ্বাস, “আমাকে পাগল ভেবেছেন?”
কুশল মৃদু হাসল। দেখল, হোটেলের লবিতে রুম-সার্ভিসের ছেলেটা একজনের সঙ্গে কথা বলছে। কুশল সেদিকে ইঙ্গিত করে রত্নদীপাকে বলল, “রুম-সার্ভিস ওই লোকটাকে কী বলল আন্দাজ করতে পারেন?”
“এতদূর থেকে আমি জানব কেমন করে?”
“আমি জানি। রুমসার্ভিস ওই লোকটাকে সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কির একটা বটলের অর্ডার দিল। লোকটা ওয়াইন-শপের রিপ্রেজেন্টেটিভ।”
“রিয়েলি!”
“বিশ্বাস না হলে ডেকে জিগ্যেস করে দেখুন।”
হাঁ হয়ে কুশলের মুখের দিকে তাকাল রত্নদীপা। তারপরে উঠে গেল রুমসার্ভিসের দিকে।
মেসেজটোন শুনে হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করল কুশল। এলার মেসেজ। সে এই রাস্তারই সামনের বাঁকে একটা মোমো কাউন্টারে অপেক্ষা করছে। রিপ্লাইয়ে যেতে পারবে না জানিয়ে কুশল লিখল – ওদিকে কিছু এগোল?
পরমুহূর্তেই রিপ্লাই এল – অনেকটা। ভদ্রলোক কনভিন্সড মনে হল। অনেক কায়দা করে কথা বলিয়েছি। খুব চাপা স্বভাবের। যেন ভিতরে কোনও কথাই নেই।
কুশল লিখল – যে-মানুষ কম কথা বলে, তার মানে তার ভিতরে কম কথা আছে এমন নয়। সে আসলে একটা উপযুক্ত পাহাড়ের জন্য অপেক্ষা করে। যেখানে কথা বললে সে তার প্রতিধ্বনি ফিরে পাবে।
ঠিক। রিপ্লাই দিল এলা।
কুশল লিখল – পরশু ওদের ফেরা। মাঝে কালকের দিন থাকলেও ওরা ফেরার জন্য গোছগাছে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং যা করার আজই করতে হবে। ট্রাই হার্ড…
লেটস সি।
কুশল হোয়াটসঅ্যাপ অফ করল। দেখল, রত্নদীপা ফিরে আসছে।
কুশল মৃদু হেসে বলল, “মিলল?”
“আপনি তো জিনিয়াস।”
“জিনিয়াস না ভয়ঙ্কর – ভালো করে ভেবে বলুন।”
“আপনাকে কিছু কথা বলতে পারি?”
“শিওর।”
“কথাগুলো খুব ব্যক্তিগত।”
মৃদু হাসল কুশল। বলল, “মন খুলে বলতে পারেন। লিপ রিডিংয়ের সঙ্গে মাইন্ড রিডও করতে পারি। তাছাড়া, অরুণিমা সান্যালের কথা কোন বাঙালি পুরুষ না শুনতে চায়, বলুন?”
কিন্তু মনে মনে বলল – শিকার টোপ গিলেছে। এবার খেলিয়ে জল থেকে ডাঙায় তোলা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
বিষাক্ত রিভার্স সুইং, সচিনের স্ট্যান্স, চার্লস ডারউইন
কুশলের কথার সূত্র ধরে সায়নদীপ বলল, “ইয়র্কার, গুগলি, বাউন্সার – এগুলো মূলত ক্রিকেটের জন্ম থেকেই খেলাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু রিভার্স সুইংয়ের সৃষ্টি পাক-বোলারদের হাতেই।”
“রাইট। কিন্তু রিভার্স সুইংয়ের কৌশলটা জানেন কী?”
“না। ঠিক…” ইতস্তত করছে সায়নদীপ।
সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কির হলদে তরলে ছোট্ট একটা সিপ দিয়ে কুশল বলল, “জেনারেলি গুড লেংথ স্পটে পিচড হওয়ার পর মনে হবে বলটা আউটসুইং হয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু না, হাওয়ার বেগকে কাজে লাগিয়ে ইনসুইং হয়ে ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে উইকেটে আছড়ে পড়বে।
যত সহজে বললাম, ব্যাপারটা তত সহজ নয়। রিভার্স সুইংয়ের জন্য ম্যাচের শুরু থেকেই প্রস্তুতি চলে। কিন্তু ডেলিভারিগুলো হয় আফটার থার্টি ফাইভ ওভারস।”
ক্রেডিটটা সম্পূর্ণ এলার। মধ্যরাতে এই ছোট্ট পার্টির প্ল্যানটা ওর। ইনফ্যাক্ট, সেজন্য তাকে কিঞ্চিত মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে। সায়নদীপ ও রত্নদীপাকে বলেছে যে আজ তাদের অ্যানিভার্সারি। তিতলি ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ার পর চারজনে সিঙ্গল মল্ট হুইস্কির বটল খুলে বসেছে।
রত্নদীপা বলল, “এ তো আশ্চর্য প্ল্যান!”
“এগজাক্টলি। আক্রম, ওয়াকাররা ম্যাচ শুরুর প্রথম থেকেই বলের একপাশকে মুখের লালা দিয়ে এবং ট্রাউজারে ঘষে মসৃণ করত। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচ গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বলের অন্যপাশটা অমসৃণ হতে থাকত। তারপর ম্যাজিক শুরু হত মোটামুটি ম্যাচের পঁয়ত্রিশ ওভার থেকে। এই বিষাক্ত রিভার্স সুইং একসময় বিশ্বের বাঘা-বাঘা ব্যাটসম্যানদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিল।”
অন্য হুইস্কির সঙ্গে এই সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কির তফাত আছে। প্রথমত, স্বাদ। দ্বিতীয়ত, ভিতরের দুলুনিটা শুরু হয় খুব ধীরে। মনের ভিতর জমে থাকা দুঃখ ও বেদনার জঞ্জালগুলো ক্রমশ পরিষ্কার হতে থাকে। ফলে হৃদয়ও চওড়া হতে শুরু করে। জীবনের তুচ্ছতাগুলো শুকনো ঝরাপাতার মতো হাওয়া লেগে উড়ে যায়, এবং মন এক অদ্ভুত আনন্দের জায়গায় পৌঁছে যায়। দু’পেগের পর প্রত্যেকেরই সেই আনন্দ শুরু হয়েছে।
“কিন্তু যত বিষাক্তই হোক, আমাদের সচিনের স্ট্যান্সের কাছে ওসব ইউজলেস হয়ে যেত। ঠিক কিনা, কুশল?” ঈষৎ জড়ানো স্বরে বলল সায়নদীপ।
“হানড্রেড পারসেন্ট নাহলেও নাইন্টি পারসেন্ট, সায়ন। আমি তো এটাকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। বিশেষত, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর সঙ্গে।”
“কীরকম?”
“আমাদের জীবন সময় বিশেষে আমাদের দিকে এইরকম বিষাক্ত রিভার্স সুইং ছুঁড়ে চলে। ক্রিজের মাটি কামড়ে আমরা যদি সচিনের স্ট্যান্স ফলো করতে না পারি, আমাদের উইকেট পড়ে যায়। মাথা নিচু করে প্যাভেলিয়নের দিকে ফিরতে হয়। তাই না?”
রত্নদীপা ও সায়নদীপ চমকে ওঠে। তাকায় পরস্পরের দিকে।
কুশল বলে, “সমস্যা কী হয়েছে, জানেন? আমরা এখন টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মেজাজে আমাদের সম্পর্কগুলোকে দেখতে শুরু করেছি। ফলে হিসেব নিলে দেখবেন, আমাদের জীবনে বিচ্ছেদের সংখ্যা ভীষণ বেড়ে গেছে। আমাদের যে ধৈর্য কমে গেছে। ক্রিজে নেমেই মারব নয় মরব গোছের মনোভাব নিয়ে ব্যাট ঘোরাই। কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকা, আমাদের সম্পর্ক তো সহিষ্ণুতা চায়, পরিচর্যা চায়। তাই না? জীবনের ছুঁড়ে দেওয়া রিভার্স সুইংগুলো তাই সহজেই আমাদের বোল্ড-আউট করে দেয়।”
এলা বলল, “সম্পর্কের অস্তিত্বের জন্য যে আমাদের প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়, সেটাই দিন দিন ভুলে যাচ্ছি। এভাবে চললে দেখবেন, একদিন আমাদের কারও সঙ্গে আর কোনও সম্পর্কই থাকবে না। স্ট্রাগল ফর এগজিসস্টেন্স, চালর্স ডারউইন তো এমনি বলেননি। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই এই স্ট্রাগলটাই আমাদের এগজিসস্টেন্সকে সুরক্ষা দেয়।”
মাথা নিচু করে সায়নদীপ ও রত্নদীপা শুনছিল। হঠাৎ সায়নদীপের হাত ছুঁয়ে গেল রত্নদীপার হাত। দুজন ঘন চোখে তাকাল পরস্পরের দিকে। সায়নদীপ তারপর হঠাৎ বাচ্চাছেলের মতো কেঁদে উঠে বলল, “স্যরি, দীপা।”
“মি টু।”
কুশল ও এলা পরস্পরের দিকে চকিতে তাকাল। কিন্তু এমন ভাব করল যেন এইমাত্র সায়নদীপ ও রত্নদীপার এপিসোডটা তারা মিস করে গেছে। ওদের আমলই দিল না। কুশল আরও এক পেগ করে গ্লাসে ভরে দিতে দিতে বলল, “ক্রিকেটমাঠের রিভার্স সুইং এবং আমাদের জীবনের রিভার্স সুইংয়ে ভীষণ মিল আছে। সময় যত গড়ায় ম্যাচের এবং সম্পর্কের রিভার্স সুইংগুলো তত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এজন্য আমাদের ভীষণ সতর্ক হয়ে ক্রিজে থাকতে হয়।”
সায়নদীপ হাত বাড়িয়ে কুশলের একটা হাত চেপে ধরে বলল, “কুশল, আপনি হয়তো নিজেও জানেন না, আপনাদের অ্যানিভার্সারিতে আমাদের কী গিফট দিলেন!”
রত্নদীপার মুখ দেখে মনে হল সেও সায়নদীপের কথাকেই সমর্থন জানাচ্ছে। এলা কুশলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি ক্লায়েন্টকে জানিয়ে দেবে হরভজন শুধু হ্যাটট্রিকই করেনি, ইডেন টেস্টে ক্যাঙারুদের ধূলিসাৎ করে দিয়েছে?”
কুশল জবাব দিল না। শুধুই হাসল।
কলকাতায় সেকেন্ড ইনিংস, ই-পেমেন্ট ও পিংক অ্যাডেনিয়াম
কলিংবেল বাজতেই কুশল ইশারা করল এলাকে। এলা গিয়ে দরজা খুলে দিল। ফ্ল্যাটের ভিতর এল রুদ্রদীপা।
কুশলকে দেখেই উচ্ছ্বসিত, “একসেলেন্ট জব, কুশল।”
“থ্যাংকস। আপনি আগে বসুন।”
সোফায় আরাম করে বসে রুদ্রদীপা বললেন, “সত্যি বলতে কী আপনাকে যখন অ্যাসাইনমেন্টটা অফার করি, তখনও আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে সাকসেস আসবে। কারণ, নিজের বোন বলেই জানি রত্নদীপা কেমন গোঁয়ার।”
“আজ তো ওদের কোর্টে হিয়ারিং ছিল?”
“হ্যাঁ। ওরা মিউচ্যুয়ালি উইথড্র করে নিচ্ছে বলে জয়েন্টলি পিটিশন করেছে।”
এলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বলল, “গুড। আচ্ছা, গ্যাংটক ট্যুর নিয়ে কোনওরকম সন্দেহ হয়নি তো?”
“না না। পুরো ব্যাপারটা এত নিপুণভাবে হয়েছে যে সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়নি। আমি যে প্ল্যান করে একই হোটেলে, ঠিক পাশের রুমেই আপনাদের জন্য বুকিং করেছি, যাতে পুরো সময়টা ওদের নজরে রেখে সুযোগ বুঝে কাউন্সিলিং করতে পারেন, ওরা টের পায়নি।”
“সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে আমরা কাউন্সেলিং করি ঠিকই, কিন্তু এভাবে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পেসেন্টদের না জানিয়ে গোয়েন্দার মতো তাদের ছায়াসঙ্গী হয়ে কাউন্সেলিং! ভেরি থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স…”
“আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আপনাদের কাছে।” বলল রুদ্রদীপা।
“না না, কৃতজ্ঞতার কিছু নেই। এটা তো আমাদের প্রফেশনাল ডিউটি। তবে কী জানেন, কয়েকটা ব্যাপার কাকতালীয় ঘটে গিয়েছিল বলে রত্নদীপাকে বশ করতে সুবিধে হয়েছে।”
“কীরকম?”
“রাস্তার পাশে বেঞ্চে বসে রত্নদীপা যে আপনার সঙ্গে কথা বলছিল এবং কী বলছিল তা আপনি জানিয়ে না দিলে লিপ রিডিংয়ের ট্রিকটা খাটত না।”
রত্নদীপার সামনে কফির ট্রে রেখে এলা হাসতে হাসতে বলল, “আর রুমসার্ভিসের ব্যাপারটা?”
কুশল হেসে ফেলল।
তারপর বলল, “আমিই কিছুক্ষণ আগে রুমসার্ভিসকে সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কির অর্ডার দিয়েছিলাম। তারপরেই রুমসার্ভিসের সঙ্গে যখন ওয়াইন শপের রিপ্রেজেন্টেটিভকে দেখি, অনুমান করতে অসুবিধে হয়নি যে আমার অর্ডারটাই রুমসার্ভিস প্লেস করছে। ফলে এ ক্ষেত্রেও রত্নদীপা ট্রিকটা বুঝতে পারেনি।”
“এনিওয়ে, আজ সন্ধেয় আমি পার্টি দিয়েছি ওদের জীবনের সেকেন্ড ইনিংসের ওপেনিংয়ের জন্য। কিন্তু প্রবল ইচ্ছে থাকলেও…” বিমর্ষ দেখাল রুদ্রদীপাকে।
“এসব ভাববেন না। আমরা গেলে পুরোটাই মাটি হয়ে যাবে।”
রুদ্রদীপা অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে মোবাইলে খুটখুট করল। মেসেজটোন বাজল এলার মোবাইলে। দেখল সেভেন্টি থাউজেন্ড ক্রেডিট হয়েছে ওদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে।
কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্রদীপা। বলল, “আসি…”
ব্যালকনি থেকে একটা পিংক অ্যাডেনিয়ামের ছোট্ট টব এনে রুদ্রদীপার হাতে দিয়ে এলা বলল, “এটা ওদের দেবেন। এই গোলাপি ফুলগাছের মতোই ওদের সম্পর্ক যেন সুন্দর হয়ে ওঠে।”
রুদ্রদীপা চলে যাওয়ার পর এলা বলল, “কুশল, আমাদের পিচে যদি রিভার্স সুইং হয়ে বল আছড়ে পড়ে?”
কুশল এক ঝটকায় এলাকে কাছে টানল।
তারপর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে বলল, “আমাদের হাতের উইলো সচিনের স্ট্যান্স জানে। ভয় কী?”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন