আশান উজ জামান
‘জাগ্রত ঝিকরগাছা’ নামের একটা বইপাগল সংগঠন আছে। তরুণ পাঠকদের নিয়ে দারুণ সব কাজ করছে ওরা। সরেজমিন সেসব দেখব বলেই গিয়েছিলাম। আমার বইগুলো পড়েছেন এমন কজন পাঠকের সঙ্গে আড্ডারও আয়োজন করবে ওরা। বলেছিল, বাস থেকে নেমে দু’মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবো। তা এমনই বৃষ্টি তখন, মনে হচ্ছিল হাঁটিয়ে না, স্রোতে আমাকে নিয়ে যেতে চায় ভাসিয়ে। ভিজতে আমার সমস্যা নেই। যখন তখন ভিজতে পারি না বলেই তো ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়েছিলাম। কিন্তু হাতে বই, পকেটে মোবাইল, আর এসেছিও কাজে। এমন সময় তো আর ভেজা চলে না।পথের পাশেই নির্মাণাধীন মার্কেট, নিচতলাটা ফাঁকা। ঢুকেই আমি চুল ঝাড়ছি, জামা ঝাড়ছি, এমন সময় কথা বলে উঠল বিরক্ত কণ্ঠ এক।
“আরে, বইগুলোও তো ভিজে গেছে, দেন তো দেখি।”
চেয়ারে বসা ভদ্র এক নারীর দিকে চোখ পড়ল। চামড়া ঢিলা হয়ে যাওয়া হাত বাড়িয়ে রেখেছেন আমার দিকে। পাঠাগারের জন্য বই নিয়ে গিয়েছিলাম কিছু। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সেগুলো দিয়েই আড়াল করেছি মাথা। আর তাদের গায়ে লেগে থাকা পানি না মুছে আমি ব্যস্ত আছিসাজপোশাকে- উনার বিরক্তির হয়তো এটাই কারণ। বুঝতে পেরে তাই চুপসে গেলাম খানিক। অনেকটা বাধ্যজনের মতোই সেগুলো এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে। নিয়ে তাদের কোলের ওপর রাখলেন তিনি। তারপর একটা একটা করে মুছতে লাগলেন আঁচল দিয়ে। এমনই যত্ন সে, দেখে বিশ্বাসই হবে না ওগুলো তাঁর বই না!
হালকা নীল আর কমলার মিশেলে স্নিগ্ধ একটা শাড়ি পরনে। চোখে চশমা, পায়ে স্লিপার, হাতে ঘড়ি। বসেও আছেন বেশ কর্তৃত্বের ভাব নিয়ে। আজিজ মার্কেটে তক্ষশীলা নামের বইয়ের দোকানটা যিনি চালাতেন, তাঁর কথা মনে পড়ল। ব্যক্তিত্বপূর্ণ রুচিশীল মানুষ, বয়সের তুলনায় সুঠাম স্থাস্থ্যের অধিকারী, আর দারুণ মিষ্টি ভাষা। খুঁজে যদি দেখা যায় এঁরা জমজ বোন, তাতে আশ্চর্য হবো না একটুও।
মোছা শেষ করে বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখছেন তিনি। যে ভয় পাচ্ছিলাম, সেটাই হলো তারপর। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়েই বললেন, “আরে, এ তো আপনারই লেখা বই, মশাই!” তারপর বাড়িয়ে দিলেন হাত। “নাইস টু মিট ইউ, ইয়াং ম্যান। আমি ইন্দিরা দেবী।” বলেই আবার ডুবে গেলেন বইয়ে। একটু একটু পড়ছেন, আর প্রশ্ন করছেন। এমন হলে আমার অস্বস্তি হয়। কিন্তু এতই আন্তরিক তাঁর জানতে চাওয়ার ভঙ্গি, আর এতই প্রাণখোলা বলছেন নিজের সম্পর্কেও, অস্বস্তিটা আর বোধ হচ্ছে না।
ভাষার টানেই বোঝা যায় উনি ভারতীয়। এদেশে এসেছিলেন সদু মোড়ল নামের একজনের প্রেমে পড়ে। এসেই দেখলেন তিনি দ্বিতীয় বউ। সতীনের ছেলেমেয়ে আছে; জমিজমার অধিকাংশই তার নামে লেখা। আর উনি ভিনদেশি, তারওপর হিন্দু, টিকবেন কী করে? ছোটবউকেও তাই জমি লিখে দিয়েছিল মোড়ল, বাড়ি করে দিয়েছিল গ্রামের বাইরে। আগের সংসারে একটা ছেলে আছে, মা বাবা ভাইবোন ছিল, বছরের অধিকাংশ সময় তিনি তাদের সঙ্গেই কাটাতেন। এ ঘরেও ছেলে হয়েছিল একটা, তবে সুখ হয়নি। ভবঘুরে হয়ে গিয়েছিল সদু মোড়ল, খোঁজ খবর রাখত না। আবার হুটহাট চলে আসত, সপ্তা দু’সপ্তা থাকত। ইন্দিরা তাই বেশিদিন থাকতেন না এখানে। ফল ফসলের মৌসুমে আসতেন, এলাকার ছেলেমেয়ে পড়াতেন, আর পড়ে থাকতেন ছেলেটাকে বুকে চেপে। কিন্তু একতরফা আর কতবেলা থাকা যায়? বাড়িঘর বিক্রি করে তাই চলে গেছেন একেবারে।
“বাহ আপনি দেখছি দেশভাগের গল্পও লিখেছেন…”
“হ্যাঁ, ওই একটাই।”
“স্বতস্ফূর্ত লেখা,”চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন “জানা গল্প আপনার?”
“আমাকে প্লিজ তুমি করে বলবেন, আমার ভালো লাগবে।”
“আচ্ছা, তাই হবে। ঘটনাটা কি জেনে লিখেছো?”
“না, দেশভাগের ভুক্তভোগী তেমন কাউকে সরাসরি দেখিনি। ওটা অনেকটাই আইডিয়া-নির্ভর গল্প, পরিবেশটাই শুধু চেনা। তবে সাতচল্লিশের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে ব্যথিত করে। যত পড়ি দেশভাগ নিয়ে, তত কষ্ট পাই। সে সবের প্রভাবেই হয়তো লিখেছি।”
শুনতে শুনতে আনমনা তিনি। তাকিয়ে আছেন বৃষ্টির দিকে। আমি তাই কথা বললাম না আর। ওদিকে আড্ডার নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সময়ের খেলাপ করছি মনে হতে পারে। মাহবুব ভাইকে তাই মেসেজ লিখলাম, “বৃষ্টিতে আটকা। কাছেই আছি।“ সেন্ড করতে করতেই উনার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পেলাম। বলে উঠলেন, “আহ! দেশভাগ!”
হাহাকারটা ছুঁয়ে গেল আমাকেও। আবার তাকালাম মানুষটার দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাইরে। বৃষ্টিও যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। তাই ভুলে গেছে থামার কথা, ঝরছেই অবিরাম। রাস্তায় স্রোতে, সিগারেটের ঠোঙা চিপসের প্যাকেট আর লিফলেটের মিছিল যাচ্ছে ভেসে। আর পানিতে অনিবার ফুটে চলেছে প্রিয় বৃষ্টিফোঁটার ফুল।
“হারটা দেখেছো?”
শুনতেই আমার চোখ গেল তার গলায়। সোনার সুতোয় বোনা বর্ণিল পাথরের একটা হার ঝুলছে সদম্ভে।। পাথরগুলো দেখতে অনেকটা ফুলো খেজুরের মতো, লম্বাটে। সেদ্ধ জলপাইয়ের চেয়ে হালকা সবুজ রঙ। সুতো পেটে নিয়ে লম্বালম্বি শুয়ে আছে তারা। মাথা ও পায়ের কাছে চারপাঁচটা করে গোল চ্যাপটা বাদামি পাথর আড়াআড়ি গাঁথা। নিচের দিকে লম্বালম্বি ঝুলে আছে আরও কটা রঙচঙা খেজুর। স্বচ্ছ না, উজ্জ্বল না, ঝকমকে না। সহজাত এক সৌন্দর্য্য আছে হারটার, আছে প্রকৃতির সতেজতা।
অতি যত্নে তাতে হাত বুলাচ্ছেন ইন্দিরা, মনে হচ্ছে হাত বুলাচ্ছেন আপন কারো গায়ে।
“কোথাকার হার জানো এটা? মহেঞ্জোদারোর। আমরা যে ভেসে আসা জাতি নই, শিকড় যে আমাদের ছড়িয়ে আছে বহুকালের অতীতে, তারই প্রমাণ এই সিন্ধু সভ্যতা। এই শহরের মানুষ সেই পাঁচ হাজার বছর আগেই নাগরিক জীবন যাপন করত। সভ্যতা সংস্কৃতিতেও উন্নতি করেছিল খুব। খননের সময় উদ্ধার করা হাজারখানেক প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে এই হারই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান।”
বলতে গেলে শিউরেই উঠলাম আমি। এত বছরের পুরোনো এই হার এভাবে সামনে আসবে আমার, তাও আবার হাতছোঁয়া দূরত্বে- ব্যাপারটা তো ভাবনারও অতীত। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ হার ইন্দিরা দেবীর কাছে এলো কী করে!
সেকথাই বললেন তিনি এরপর।
“দেশভাগের চক্রে পড়ে ভাগ হয়ে যাচ্ছিল সব। ঠিক হয়েছিল, হারটাও ভাগ করা হবে।মহেঞ্জোদারো খনন কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন অজয় সিকরা নামের একজন। হারটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব তিনি জানতেন। অবসর যাপন করছেন তখন। নিজের দেশটা চোখের সামনে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, কিছু করতে পারছেন না; ভেতরে ভেতরে পুড়ছিলেন। তাতে যেন ঘি ঢেলে দিলো ওই হারভাগের পরিকল্পনার খবর। না, এ তিনি হতে দেবেন না। সাধ্যমতো এ দল ও দল, এ নেতা সে নেতা করে বেড়ালেন। সবাইকে অনুরোধ করলেন সিদ্ধান্তটা বাতিল করতে। কিন্তু কারোরই নাকি করার কিছু নেই। কোথাও কোনো আশা না পেয়ে তিনি ছুটে গেলেন জাতীয় সংগ্রহশালায়, যেখানে সংরক্ষিত ছিল ওই হার। নরেশ মৈত্রী নামে অজয়ের এক বন্ধু ছিলেন ওই সংগ্রহশালার কর্মচারি। ভীষণ ইতিহাসপাগল লোক ছিলেন তিনি। দেশব্যাপী প্রত্নস্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা ছিলো তার নেশা। যেখানেই যেতেন, কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন স্মারক হিসেবে। ছেলেমেয়ে ছিল না, ঘরজুড়ে গড়ে তুলেছিলেন সংগ্রহশালা। পড়া আর ওসবের রক্ষণাবেক্ষণ করেই সময় কাটত তার। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ঠিক জায়গাতেই গিয়েছেন অজয় সিকরা।”
এটুকু বলে থামলেন ইন্ডিয়া দেবী (ছোটবেলায় নাকি এভাবেই নিজের নাম বলতেন ইন্দিরা)। পাশে রাখা ব্যাগে পানির বোতল। বের করে খেলেন একটু। আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন তারপর। আমি ধন্যবাদ জানালাম। ঠোঁটে লেগে থাকা পানি আঁচলে মুছে তিনি শুরু করলেন আবার।সম্পর্কে এই নরেশ মৈত্রী ইন্দিরা দেবীর জ্যাঠা।
“অজয় এসে বলার আগে নাকি জ্যাঠা জানতেনই না হারটার ব্যাপারে। ফলে সেদিনই প্রথম সেটা দেখলেন তিনি। সেকথা পাওয়া যাচ্ছে ডায়রিতে লেখা তার সেদিনের ভুক্তিতে- ‘আহা, এ তো হার না, যেন ইতিহাস শুয়ে আছে- সোনার সুতোয় বোনা বর্ণিল ইতিহাস।’ দু’জন মিলেই তারা তোড়জোড় শুরু করলেন এবার। তা এই দৌড়াদৌড়ির মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন অজয়। একা একা কী করবেন জ্যাঠা তখন? মুখচোরা মানুষ, নেতাদের হাতপায়ে ধরার সুযোগ ছিলো না। পুরুতের দৌড় তো মন্দির পর্যন্তই, সংগ্রশালার পরিচালককেই তাই ধরলেন তিনি। কিন্তু তিনিও নিরুপায়। ওদিকে আবার ঘনিয়ে আসছে হারভাগের সময়।তুকতাক জানতেন জ্যাঠা। অফিসের সবারই কোনো না কোনো ব্যামো সারিয়েছেন। আলাপ পরিচয়ও ভালো। সবাই তাকে পছন্দ করে, দাদা দাদা করে ডাকে। ফলে তার প্রবেশাধিকার ছিল সবার কক্ষেই। চাবির গোছা থেকে ঠিক চাবিটা সরিয়ে নেওয়া কঠিন হয়নি তাই।”
কিন্তু হাতে নিয়ে সেটা দেখার লোভ সম্বরণ করাটা তো কঠিনই হয়ে পড়ছে আমার জন্য। যত দেখছি হারটা, যত ভাবছি তার ব্যাপারে, তত যেন প্রেমে পড়ছি তার। স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু অভদ্রতা হবে বলে চাইতে পারছি না।
“ওই ঘটনার পরপরই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, নাকি চলে গিয়েছিল জানি না, বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে জ্যাঠা চলে এসেছিলেন বাড়ি। উদাসীন মানুষ, আরো বেশি আলাভোলা হয়ে গিয়েছিলেন সেসময়। তার দেখভাল করতেন আমার মা। একটা ছোটবাক্স ছিল জ্যাঠার। খুব কদর করতেন বাক্সটাকে। মা বলেছিলেন, ‘এমন কোন দিন যায়নি, বাক্সটা খুলে যেদিন বসে থাকেননি দাদা। মাঝে মাঝে মনে হতো, দেখি তো কী এমন আছে ওতে। তবে তার উপায় ছিলো না।’ মাকেই জ্যাঠা দিয়ে গিয়েছিলেন বাক্সটার ভার। নিষেধ করেছিলেন খুলতেও। কিন্তু মরণের পর তার জিনিসপত্র ভাগাভাগির সময় আর নিষেধ মানেনি কেউ। আশাহতই হয়েছিল তারা, বলা বাহুল্য। ক’টা নোটবুক আর তামার কৌটায় ভরা এই হারটা ছাড়া তাতে ছিল না কিছু। বাক্সটা নিয়ে তাই টানাটানি হয়নি আর। অন্যকিছু জিনিসপত্রের সাথে সেটা পড়েছিল বাবার ভাগেই। একজন মানুষ যেতে না যেতেই তার জিনিসপত্র ভাগাভাগি মেনে নিতে পারেননি বাবা। রাগে রাগে বাক্সটা ফেলে রেখেছিলেন স্টোররুমে।”
শুনতে শুনতেই আমি গুগল করার চেষ্টা করছি। কিন্তু নেটের অবস্থা খুব খারাপ। মহাধৈর্যের বিনিময়ে একটা আর্টিকেল পাওয়া গেল। সংক্ষিপ্ত, কিন্তু কাজের। বলছে, একটা নর্তকীর আর একটা পূজারির মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল মহেঞ্জোদারোর অবশেষে। সঙ্গে ছিল বহু ছোটবড় গহনা। তবে সেসব ছিল ভাঙাচোরা, ছেঁড়াখোঁড়া। অক্ষত ছিল একমাত্র এই হারটাই। তবে সেটা চুরি হয়েছে বলে তো উল্লেখ নেই কোন! বরং নির্ধারিত দিনে ঠিকঠিকই ভাগ হয়েছিল সেটা। এক টুকরো তার পাকিস্তানে, অন্যটা ভারতে। ক’বছর আগে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল আমেরিকায়, জোড়া লাগিয়ে অখণ্ড হারটা সেখানে প্রদর্শনের প্রস্তাব দিয়েছিল আয়োজকেরা। ভারত রাজি হয়নি বলেই আর বিচ্ছেদ ঘোচেনি হারের টুকরো দুটোর। পড়ছি আর দুরুদুরু করছে বুক, কষ্ট লাগছে হারটার জন্য। আহারে, কী বেয়াক্কেলে মানুষ আমাদের নেতারা!
তা না হয় হলো, কিন্তু ইন্ডিয়া দেবীর হারটা তাহলে এলো কোথা থেকে? নরেশ মৈত্রী কি তবে ভুল হার চুরি করেছিল? নাকি ইন্ডিয়া দেবীই আমাকে ভাঁওতা দিলেন? সেটাই হবার কথা, অমন একটা হার চুরি হয়ে যাবে আর চুপচাপ বসে থাকবে কর্তৃপক্ষ, এমন হয়? প্রশ্নের ভারে হেলে পড়ছে দিন। বৃষ্টির তোড়ও বেড়েছে। ভাবনাও আমার গড়িয়ে যাচ্ছে পানির মতো- ভাঁওতা, নাকি অন্য কিছু? কিন্তু কীভাবে সেটা জিজ্ঞেস করব, বুঝতে পারছি না।
“ছোট থেকেই আমার পড়ার বাতিক। যা পাই তাই পড়ে ফেলি। বই এনে এনে অধৈর্য্য হয়ে যেত বাবা মা। মাধ্যমিকে পড়ি যখন, তখন ক’দিন বৃষ্টি হলো টানা। রাস্তাঘাটে জল জমে গেছে, বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে শুয়ে বসে অস্থির লাগছে। পড়ার মতো বই বাকি নেই। কী পড়ব কী পড়ব করছি। জ্যাঠার লিখে যাওয়া ডায়রিগুলো তখন বের করে দিলো মা। তারপর স্নানাহার বাদ, পড়ছি আর পড়ছি। হারচুরির প্রসঙ্গ এলো যখন, তখন আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। দৌড়ে গিয়ে বের করে আনলাম অমূল্য ধন। গলায় সেটা গলিয়ে নিতেই মনে হলো ছুটে গেছি পাঁচ হাজার বছর আগে। কী যে উত্তেজনায় বোধ করছিলাম তখন, বলে বোঝাতে পারব না!”
গায়ের রোম শিউরে উঠছে তাঁর, খেয়াল করলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো। বৃষ্টি দেখলেন। সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া সহ্য করতে পারি না বলে দূরে সরে দাঁড়িয়েছি। এমন সময় ‘অপারবাংলা ওয়েবজিন’এর শুভ নাথ দাদার মেসেজ। নতুন সংখ্যার জন্য একটা গল্প দেওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত দিন পার হয়ে গেছে, গল্প লেখা হয়নি। এবারের উপন্যাসটা লিখতে গিয়েই তালগোল পাকিয়েছি আসলে। গত প্রায় বছরখানেক আর লেখাই হয়নি কিছু। ক’দিন আগে ‘গল্পদেশ’ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় গৌতম অধিকারী দাদার সঙ্গেও এমন হয়েছে। বাধ্য হয়ে বলেছি পরের সংখ্যায় দেবো। ‘অপারবাংলাকে’ও তেমনই কিছু একটা বলতে হবে ভাবছি। তার আগেই অবশ্য সময় বাড়িয়ে দিলেন শুভদা। খুশি খুশি মোবাইলটা পকেটে রাখছি, এমন সময় মাহবুব ভাইয়ের মেসেজ। ‘কোথায়, ভাইজান?’ যত সংক্ষেপে পারা যায় জানিয়ে দিলাম হদিস। তারপর ফিরে এলাম হারের কাছে। নাক বন্ধ করে আছি তখনো। ভাঁওতা বিষয়ক প্রশ্নগুলো পাকাচ্ছে ভেতরে। দুইয়ের চাপে উশখুশ করছি। তা আর কতক্ষণ করব? ঠাস করে তাই বলেই ফেললাম, “হারটা মনে হচ্ছে নকল…”
“গুগল করেছো, না? দেখেছি।” বলে সিগারেটের জ্বলন্ত মুখটা চেপে ধরলেন চেয়ারের পায়ায়। বললেন, “পুরোটা শোনো আগে, তারপরই না আসল নকল ভেদ।দেশভাগ নিয়ে বিস্তারিত পড়েছি যখন, এই হারের আসল নকল চিন্তাটা আমাকেও ধাক্কা দিয়েছিল। সেকারণেই আবার পড়তে শুরু করেছিলাম জ্যাঠার ডায়রিগুলো। কিন্তু তাতেও আর নতুন কিছু পাইনি। ফলে বেশ একটা খচখচানি নিয়েই সময় কাটছিল। তারপর অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই জানতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা। জ্যাঠার বাক্সতে কিছু চিঠি ছিল। নিতান্তই সাধারণ চিঠি সেসব। তার ভেতরে দুটো জ্যাঠার নিজেরই লেখা, লিখেছেনও নিজের কাছেই। তাতেই লেখা ছিল এই হারবিষয়ক মিসিং পিস।হারটা চুরি করে আনার পরই খটকা লেগেছিল জ্যাঠার মনে যে, ভাগ করতে এসে ওটা না পেলেই শুরু হবে খোঁজাখুঁজি। ঠিকই তখন জানাজানি হয়ে যাবে যে চুরি হয়ে গেছে। তা হোক, কে চুরি করেছে তা কে জানে? প্রমাণ তো নেই। তবু, ভয় কাটছিল না তার। যদি ধরা পড়েন, যদি জেনে যায় সবাই? মাথা কাটা যাওয়ার ভয় তো ছিলই, হারভাগ যে রোখা যাবে না, সেই চিন্তাও হচ্ছিল তার। বুদ্ধি করে তাই সোজা চলে গেলেন এক বন্ধুর কাছে। চকমকি পাথর বিক্রি করে বড়লোক হয়ে উঠেছে লোকটা। বিশাল বিশাল শোরুম তার। দরকারি পাথর খুঁজে খুঁজে ছিদ্র করিয়ে নিলেন জুতমাফিক। ঘরে ফিরে তারপর নিজের গলার সোনার চেইনে নিজেই বুনে ফেললেন হার একখান। শেষ দিকের লেখায় এই জন্য তার দারুণ দুঃখবোধের উল্লেখ দেখি। এমন একটা অমূল্য সম্পদ তিনি চুরি করেছেন, আত্মসাতই করেছেন বলতে গেলে। বহুবার নাকি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন তারপর, কিন্তু জেল খাটার ভয়ে পেরে ওঠেননি। নিজেই আবার স্বান্ত্বনা দিতেন নিজেকে- ভারতবর্ষের এই অকৃত্রিম নিদর্শন তিনি ভাগ হতে দেননি।”
আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইন্ডিয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলছি আমিও। কেমন যেন ভজঘট পাকিয়ে গেছে চিন্তা। আর্টিকেলটায় যে ছবি আছে, তার সঙ্গে হুবহু না হলেও মিল আছে হারটার। নিচে ঝুলে থাকা পাথর তিনটা বাদে অন্যগুলো মনে হচ্ছে একই পাথর। তারমানে নরেশ মৈত্রী সত্যিই একটা হার গড়েছিলেন। এখন এই হারটা আসল হলে, নকলটাই কি ভাগ হয়েছে সাতচল্লিশে! না হলে সেটা বদলে গেল কী করে? অস্থির লাগছে। চক্ষুলজ্জা ভুলে এবার আমি বলেই ফেললাম, “একটু কি দেখতে পারি হারটা?”
“গলায় ঝুলছে, দেখতে তো পাচ্ছোই।” হাসিমুখে বললেন তিনি। তারপর খুলতে গিয়ে সেটার গায়ে হাত বুলাতে লাগলেন ইতস্তত। “কষ্ট পেয়ো না, দাদা, আমি খুলতে পারব না। এমনিতেই বড় বিপদে আছি এটা নিয়ে।”
বিপদের কথাটাও বললেন।বড় হয়ে ছোট ছেলেটা বলেছে, হিন্দুদের দেশে থাকবে না। মাকে ফেলে সত্যিই সে চলে এসেছে বাবার দেশে। বিয়ে করেছে, বাচ্চা হয়েছে। তার টানেই মাঝে মাঝে এখানে আসেন ইন্দিরা দেবী। তবে এবার এসেছেন সদু মোড়লের জন্য। বুড়োটা অসুস্থ, হসপিটালে আছে। যদিও ইন্দিরাকে ঢুকতে দেয়নি বড়বউয়ের ছেলেমেয়েরা।
“তাদেরই বা আর দোষ দেবো কী, নিজের ছেলেটাকেই তো মানুষ করতে পারলাম না!”
আগের পক্ষকে দিয়ে থুয়ে ধনসম্পদ বিশেষ কিছু আর ছিল না সদু মোড়লের, ছেলেটাকে তাই কিছু দিতে পারেনি। ছেলেটা তাই ভালো নেই খুব একটা। ইন্দিরা বলেন তার কাছে যেতে, তা সে যাবে না। আবার মায়ের সম্পদের ভাগ চায় সমান। তা দিতে আপত্তি ছিল না মায়ের। জমিজমা টাকা পয়সা যা আছে, নিজের চলার মতো কিছু রেখে তিনি ভাগ করে দিয়েছেন দুইছেলের নামে। তাতেও হয়নি। এবার এই হারটার দিকে নজর পড়েছে। কিন্তু এই জিনিস ভাগ করার সাধ্য কি আছে ইন্ডিয়া দেবীর, নাকি সেই ইচ্ছে আছে তার? এই নিয়ে ঝগড়া।
ঝগড়ার ঝড়ে বেরিয়ে এসেই পড়েছেন বৃষ্টির কবলে। বেলা পড়ে এলো। এখনো যদি যেতে না পারেন, বর্ডার পার হবেন কখন, বাড়ি পৌঁছবেন কখন। এমন অবস্থা যে, এখানে থাকবারও উপায় নেই.. আরেকটা সিগারেট ধরালেন তিনি। আর মুহূর্তেই ধোঁয়া এসে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল আমায়। গিয়ে মোবাইল বের করছি, কোন মেসেজ এলো কি না দেখব- এমন সময় মাহবুব ভাই হাজির। ইয়াবড় এক ছাতার নিচে জ্বলছে তার মিষ্টিহাসির সূর্য। “দেরি হয়ে গেল, না ভাই? সরি।” কানে হাত দিয়ে বললেন উনি। এত অমায়িক লোকটা, লজ্জায় পড়ে যেতে হয়। আমারই না উচিত দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়া? কতক্ষণ ধরে বসিয়ে রেখেছি। আমি অবশ্য ঠিক সময়েই এসেছি, দোষ সব এই বৃষ্টির। হাসতে হাসতে বললাম।
তবে বৃত্তান্ত শুনে হাসি মুছে গেল আমার। শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেন বসে আছেন আমার জন্য! কেন, এমন তো কোন কথা ছিল না। আমি তো ভেবেছি আড্ডাশেষে নিজেই গিয়ে দেখা করব তাঁর সঙ্গে। “তা সবকিছু কি আপনাকে জানিয়ে করব নাকি” বলে হাসতে লাগলেন মাহবুব। তারপর আবার তিনিই করলেন উদ্ধার। “আরে না, হোসেন কাকু একটা কাজে এসেছিলেন। ভাবলাম যে আপনি আসছেন, কিছুক্ষণ থাকলেই তো দেখা হয়ে যাবে। তাই রেখে দিয়েছিলাম। তা আপনি না এসে যে বৃষ্টিকে পাঠাবেন এভাবে, কে জানত!”
ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না! এখানে না দাঁড়িয়ে যদি চলে যেতাম ভিজতে ভিজতে, তাতে অবশ্য ইন্ডিয়া দাদির সঙ্গে দেখা হতো না।
“আচ্ছা মাহবুব ভাই, একটা মিনিট সময় নেবো শুধু। আসেন পরিচয় করিয়ে দিই…” বলে ঘুরে তাকিয়েছি, দেখি চেয়ারটা ফাঁকা। ফাঁকা না ঠিক, আমার বইগুলো পড়ে আছে। চেয়ারের পাশে তাঁর ব্যাগটা ছিল, সেটাও নেই। তাহলে? কোথায় গেলেন এইটুকুর মধ্যে! বৃষ্টি ধরে এসেছে। বাসস্টপে ছাড়ব ছাড়ব করছে একটা বাস। ওতেই কি উঠে বসেছেন? গেলে কি একটা ছবি তোলা যাবে না? কিন্তু ছুটতে গিয়েই দেখি ছেড়ে দিলো বাসটা।
মাহবুব ভাই দেখলেন মামুলি একটা বাস চলে গেল।
আমি দেখলাম চলে গেল ইতিহাস।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন