travel-simbar-apondeshe

সিম্বার আপনদেশে
শুক্তি রায়

আফ্রিকার ডায়েরি।
১৯ শে অগাস্ট ২০১৯।
পথ চলা শুরু।

অনুভবের গল্পটা কোথা থেকে শুরু করি? মনে হয় স্মৃতির রাস্তা ধরে পিছোতে পিছোতে গিয়ে শেষমেশ ঠেকব সেই চাঁদের পাহাড়ে। আমাদের সবার ছোটবেলা জুড়ে রয়েছে ওই রহস্যময় চাঁদের পাহাড়ের হাতছানি। আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই যে আফ্রিকা একটা দেশ নয়… একটা মহাদেশ যার উত্তরে আছে সুবিশাল সাহারা মরুভূমি যার কোল ঘেঁষে অবস্থিত নীলনদ বিধৌত মিশরীয় সভ্যতার অবশেষ আর দক্ষিণে সেই উত্তমাশা অন্তরীপ যার পাশ দিয়ে অতলান্তিক মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে পড়ে এই দেশে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেছিলেন ভাস্কো দা গামা।

এবারের অরণ্য দর্শনের পরিকল্পনায় আমাদের দ্রষ্টব্য ছিল মাসাইমারা, নাকুরু হ্রদ, নাইভাশা হ্রদ, আম্বোসিলির জঙ্গল আর তানজানিয়ার গোরোংগোরো বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। কলকাতা থেকেই ভিসা, প্লেনের টিকিট আর সাফারি এবং জঙ্গলের কাছাকাছি রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম আমরা।

কেনিয়ায় যাওয়ার জন্য পীতজ্বরের টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক। তার জন্য নির্দিষ্ট সরকারী ব্যবস্থা আছে। টিকা নেওয়ার প্রমাণপত্র পেশ করলে তবেই ভিসা মেলে। সেই সমস্ত করণীয় সেরে, ব্যাগপত্র গুছিয়ে, ক্যামেরা রেডি করে অবশেষে ১৮ই আগস্ট সন্ধ্যার মুখে রওনা হলাম আমরা। কলকাতা থেকে মুম্বাই আর তারপর সারা রাত এয়ারপোর্টে কাটিয়ে ভোরের উড়ানে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি। মুম্বাই পৌঁছলাম রাত এগারোটার পর। মালপত্র সংগ্রহ করে গাড়ি ধরে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। চেকইন কাউন্টারে বিসর্পিল লম্বা লাইন। খবর নিয়ে জানলাম যে ওই লাইন ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স-এর। আরো ঘণ্টা দেড়েক পর অর্থাৎ রাত দেড়টা দুটো নাগাদ আমাদের, অর্থাৎ কেনিয়ান এয়ারলাইন্স-এর চেক ইন শুরু হবে। অতঃপর অপেক্ষা। তারপর পাক্কা দুটি ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মালপত্র রওনা করিয়ে, আবার লম্বা লাইন পেরিয়ে ‘সুরক্ষা জাঁচ’ সমাধা করে, ইমিগ্রেশন-এর ঝক্কি মিটিয়ে কিঞ্চিত সময় পাওয়া গেল কিছু মুখে দেওয়ার। কিন্তু তখন শরীর আহারের তুলনায় বিশ্রাম দাবি করছে বেশি। যাই হোক সামান্য কিছু খেয়ে চলে গেলাম বোর্ডিং গেটে। প্লেনে ওঠার সময় আকাশ জুড়ে নতুন দিনের ফিকে আলোর আভাস ছড়ানো দেখলাম। প্লেনে উঠে যে যার সিটে বসে সিট বেল্ট বেঁধে সেই যে ঘুমিয়ে পড়লাম, ঘুম ভাঙল প্লেন আকাশে ওঠার পর যখন বিমানসেবিকারা প্রাতরাশ নিয়ে এল সেই সময়। কোনো মতে কিছু একটা খেয়ে আবার বুজে এল চোখ।

আমাদের উড়ান ছিল পশ্চিম দিকে, ফলে আমরা ভারতীয় সময় থেকে ক্রমশঃ পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। কেনিয়ার সঙ্গে আমাদের সময়ের তফাৎ আড়াই ঘণ্টার। কেনিয়ার সময় সকাল দশটা নাগাদ নাইরোবি বিমানবন্দরে নামলাম। সেখানে ইমিগ্রেশন ইত্যাদি সেরে মালপত্র নিয়ে স্টেশনের বাইরে এসেই পেয়ে গেলাম আমাদের জন্য অপেক্ষারত আগে থেকে সুব্যবস্থিত Private Safari কোম্পানির গাড়ি। কলকাতা থেকেই আমাদের ভ্রমণের যাবতীয় ব্যবস্থা করে রেখেছিল সুপরিচিত Travel Agency SOTC। গাড়িতে উঠে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে গেলাম হোটেলের দিকে। আমাদের হোটেলের নাম Tamarind Tree অর্থাৎ তেঁতুল গাছ। দূর বিদেশে আমাদের চেনা তেঁতুল গাছের নামে একটা চমৎকার হোটেল! বেশ একটা আত্মীয়তাবোধ জাগল যেন।

হোটেলটা সত্যি চমৎকার। খাওয়া দাওয়া সবই বেশ ভালো। তবে কেনিয়াতে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। ৫০০ মিলিলিটারের এক বোতল পানীয় জল কিনতে ভারতীয় টাকায় ২০০ টাকা মতো লেগে যায়। আর সর্বনাশের মাথায় বাড়ি হল এই যে, এখানকার কলের জল ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের মতো পানের উপযুক্ত জল নয়। ফলে বোতল ছাড়া গতি নেই।

নাইরোবি শহর বোধহয় বিশ্বের একমাত্র রাজধানী শহর যার মধ্যেই রয়েছে একটা গোটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। হোটেলে আসার পথেই গাড়ি থেকে চোখে পড়েছিল এক জোড়া জেব্রা। আমাদের হোটেলের কাছেই সেই পৃথিবী বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ‘কার্নিভোর’, যেখানে খাদ্য হিসেবে পাওয়া যায় বন্য জন্তুদের মাংস। বন্যপ্রাণীর মাংস খাওয়ার ইচ্ছা আমাদের কারোরই ছিল না। আমরা তাই হোটেলেই খেয়েছি, বিশ্রাম করেছি এবং শরীরকে প্রস্তুত করেছি আগামী দিনগুলোর ধকলের জন্য।

দুই

২০ শে অগাস্ট ২০১৯।

অরণ্যের গভীরে

যদিও আমাদের গুগল আবহাওয়া দপ্তর যথেষ্ট ভয় দেখিয়েছিল বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টির, ২০শে আগস্ট সকালটা ছিল রোদ্দুর ঝলমল। ঠিক সকাল সাড়ে সাতটায় ব্রেকফাস্ট সমাধা করে আমরা রওনা হলাম বনবাসের পথে। নাইরোবিতে এর আগে আমরা এসেছিলাম ২০১২ সালে। এই সাত বছরে অনেক বদলে গেছে নাইরোবি শহর। ড্রাইভাররা দেখলাম বেশ আতংকিত থাকে নাইরোবির ট্র্যাফিক জ্যাম নিয়ে। সে কারণেই নাইরোবি শহরকে পাশ কাটিয়ে তৈরি হয়েছে দুটো বাইপাস… নর্দার্ন বাইপাস আর সাদার্ন বাইপাস। আমাদের গাড়ি চলল সাদার্ন বাইপাস ধরে মাসাইমারা অভিমুখে। চালকের নাম জর্জ। সে কেনিয়ারই ভূমিপুত্র, মেরু উপজাতিভুক্ত। কেনিয়ার আদত বাসিন্দারা সবাই ওখানকার আঠাশটি উপজাতির মধ্যে কোনো না কোনো উপজাতির অংশ। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কিকুয়ু উপজাতির। এছাড়াও আছে আকাম্বা, বান্টু, অবশ্যই মাসাই উপজাতির মানুষরা। মাসাইদের নাম তো সবাই জানে। এরাই একমাত্র বজায় রেখেছে এদের সাবেকি জীবনধারা। এরা যাযাবর। গরু, ভেড়া, ছাগল ও গাধা পালন করা এদের মূল জীবিকা। গৃহপালিত জীবদের নিয়ে এরা বাস করে জঙ্গলের উপকণ্ঠেই। জঙ্গলই এদের চারণভূমি। এছাড়া এদের মেয়েরা চমৎকার সব পুঁতির গয়না তৈরি করে বিক্রি করে পর্যটকদের কাছে। কেনিয়াতে জিনিস কিনতে গেলে দামাদামি মাস্ট। কী দোকানে, কী মাসাই মহিলাদের কাছে, একেবারে গড়িয়াহাট, হাতিবাগানের স্টাইলে দরাদরি করতেই হবে পছন্দের জিনিসটি কিনতে।

জর্জ আমাদের নানা রকম তথ্য সরবরাহ করছিল কেনিয়া এবং তার বন্যপ্রাণ সম্পর্কে। এখনই সব চেয়ে উপযুক্ত সময় মাসাইমারা বেড়াতে যাওয়ার কারণ এই সময়টা জুড়েই হাজারে হাজারে তৃণভোজী প্রাণী তানজানিয়ার সেরেঙ্গেটি থেকে দল বেঁধে রওনা হয়ে কুমির অধ্যুষিত মারা নদী পার হয়ে কচি ঘাসের খোঁজে এসে হাজির হয় বৃষ্টি বিধৌত মাসাইমারাতে। এই ব্যাপারটাকে Nat Geo বা Animal Planet এর কল্যাণে আমরা জানি The Great Migration হিসেবে। তাই এই সময় তামাম বিশ্বের বন্যপ্রাণী বিশারদ এবং বন্যপ্রাণী প্রেমিক মানুষরা হাজির হয় মাসাইমারায়। আমরাও সেই কারণে এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছি মাসাইমারা ভ্রমণের জন্য।

নাইরোবি থেকে মাসাইমারার দূরত্ব প্রায় তিনশো কিলোমিটার। যাত্রাপথে প্রথম বারের জন্য গাড়ি থামল Rift Valley র সামনে। এই Rift Valley আসলে ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইখানে তিন দিক থেকে থেকে এসে এক জায়গায় মিশেছে Arabian, Nubian & Somalian Tectonic Plates। খালি চোখে অবশ্য এই চ্যুতির কিছুই ঠাহর হয় না। আমরা দেখতে পেলাম একটা বিশাল উপত্যকা যার ওপারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটা আগ্নেয়গিরি, যার মধ্যে অনেকগুলোই এখনো সক্রিয়।

Rift Valley র গা ঘেঁষে চলেছে আন্তর্জাতিক মহাসড়ক, কেনিয়াতে যার নাম A1। ইস্রায়েল থেকে শুরু হয়ে ৯,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তা মিশর, সুদান, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, কেনিয়া পেরিয়ে শেষ হয়েছে মোজাম্বিক-এ গিয়ে। এই সব রাস্তা চোখের সামনে দেখলে আপনিই যেন কল্পনার আগল খুলে যায়।

আবার যাত্রা হল শুরু। Rift Valley র পর থেকেই মাটির রং গেল বদলে। গাঢ় লালচে রঙের মাটি পরিবর্তিত হল হলদেটে বাদামি রঙে। ফসলের ক্ষেত নেই বললেই চলে। মাইলের পর মাইল তৃণভূমি আর তার বুকে এখানে ওখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ছাতা আকৃতির আম্ব্রেলা অ্যাকাশিয়া গাছগুলো। চোখে পড়ছিল নানা জাতের ক্যাকটাস। কারো মাথায় হলুদফুলের মুকুট তো কেউ সেজেছে লাল ফুলের ঝুঁটিতে। কোথাও আবার অ্যাকাশিয়া আর ক্যাকটাস গা জড়াজড়ি করে হাত বাড়িয়েছে আকাশের দিকে। গাছগুলো ভরে আছে রোঁয়ারোঁয়া দেখতে পাখির বাসাতে।

প্রায় ঘণ্টাদুয়েক পর গাড়ি এসে থামল নারোক-এর একটা স্যুভেনির শপ-এ। সেখানে হস্তশিল্পের সম্ভার ছাড়াও আছে চা কফি পান এবং বাথরুমে যাওয়ার চমৎকার ব্যবস্থা। দোকানে কিছু কিনলে বা খেলে বাথরুম যেতে পয়সা লাগে না নতুবা দাম দিতে হয় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার। গোটা স্যুভেনির শপ জুড়ে এবোনি কাঠে খোদাই করা সব মূর্তি। আকাম্বা উপজাতির লোকেরা এই মূর্তিগুলো তৈরি করে। আফ্রিকার কোথাও হস্তশিল্প সস্তা নয়। অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলে, ‘হ্যান্ড মেড… নট চীপ’। অদ্ভুত ভাবে খেয়াল করলাম যে রাস্তার ধারে কোথাও গড়াগড়ি খাচ্ছে না খালি বোতল বা চিপসের খালি প্যাকেট। কেনিয়ার যত্রতত্র সিগারেট খাওয়া বেআইনি। বিশাল অংকের ফাইন হয় স্মোকিং এরিয়ার বাইরে সিগারেট খেলে এবং এই আইন ওদের দেশের মানুষ বা বিদেশী, সবার জন্যই একই ভাবে প্রযোজ্য।

নারোক থেকে তিরিশ কিলোমিটার মতো গিয়ে মাসাইমারা ন্যাশনাল রিসার্ভ-এর তোরণ আর সেখান থেকে আরো সাত আট কিলোমিটার বনপথ পেরিয়ে একেবারে জঙ্গলের মধ্যে আমাদের তিনদিনের থাকার জায়গা ‘মারা সিম্বা লজ’। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হোটেলের দিকে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল জেব্রা, ইম্পালা, এবং বেশ কয়েকটা দীর্ঘাকৃতি মাসাই জিরাফ। জিরাফগুলো গাড়ির এত কাছে চলে এসেছিল যে ছবি তোলাই কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। আমরা উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাচ্ছি আর আমাদের ড্রাইভার সাহেব বারবার তাড়া দিচ্ছে যাতে আমরা লাঞ্চ বুফে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে হোটেলে পৌঁছোতে পারি।

জঙ্গলের পরিবেশকে বজায় রেখে কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি আমাদের হোটেল। ঘরের ব্যালকনি থেকেই দেখা যাচ্ছিল ক্ষীণস্রোতা তারেক নদী, যেটা মাসাইমারার মূল নদী মারা-র উপনদী। নদীর চরে আরামে রোদ পোহাতে দেখলাম একটা বড় সড় কুমিরকে আর বেশ কয়েকটা ব্রোঞ্জ রঙের গোসাপকে। ইজিপশিয়ান গুজ আর সারস ছাড়াও চোখে পড়ল নদীর ওপারের জঙ্গলের গাছে দল বেঁধে দাপাদাপি করতে থাকা একদল কালো বেবুন।

দুপুরের খাওয়া সেরে বিকেল চারটেয় সাফারি। আমাদের গাড়ি এবং আমাদের ড্রাইভারই আমাদের নিয়ে চলল অরণ্য ভ্রমণে। জঙ্গলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল নানা ধরনের অ্যান্টিলোপ, যেমন ইম্পালা, টোপী, থমসনস গ্যাজেল এবং রাজকীয় চালে হাঁটতে থাকা মাসাই জিরাফের দল। একটু এগিয়েই একটা জায়গায় বেশ কিছু গাড়ির ভিড় দেখেই বুঝলাম ওখানে দেখার মতো কিছুর দর্শন মিলেছে। খেয়াল করে দেখতেই দেখা মিলল একটা চিতাবাঘের। প্রসঙ্গত, বলে রাখি চিতা আর চিতাবাঘ বা লেপার্ড উভয়েই বিড়াল গোত্রের হলেও প্রাণী হিসেবে ওরা আলাদা। লেপার্ড বা চিতাবাঘ যাকে উত্তর ভারতে তেন্দুয়া বলা হয়, পৃথিবীর নানা দেশেই পাওয়া যায় কিন্তু সরু ঠ্যাঙের দৌড়বাজ চিতা কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটা জঙ্গল ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। হলদেটে বাদামি রঙের চিতাবাঘের চেয়ে আকারে বড় চিতার গায়ের রং সাদাটে ধূসর এবং ওদের গায়ের ছাপও এক রকম নয়। চোরাশিকারিদের দৌরাত্মে, সিংহ এবং হায়নাদের যূথবদ্ধ আক্রমণে চিতারা দ্রুত নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে এখন। লেপার্ডদের সংখ্যা এখনো খুব কম নয় তবে নগরায়নের কারণে যেভাবে তাদের বাসস্থান কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, ওদের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে।

অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে লেপার্ডটাকে দেখার জন্য কিন্তু কেউ কোনো ভাবেই ওকে বিরক্ত করার চেষ্টা করছে না। আফ্রিকাতে সাফারির সময় নীরবতা বজায় রাখা এক্কেবারে আবশ্যিক। লেপার্ডটা স্পষ্টতই ভয় পেয়েছে, ছোট ছোট ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আত্মগোপন করার চেষ্টা করছে। মাসাইমারাতে বড় গাছ নেই বললেই চলে। ছোটখাটো ঝোপঝাড় আর আদিগন্ত তৃণভূমি নিয়েই মাসাইমারার জঙ্গল। কিছুক্ষণ আত্মগোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে লেপার্ডটা কী রকম ‘ধ্যাত্তেরিকা !’ ভঙ্গীতে বেরিয়ে এল এবং সমবেত দর্শনার্থীদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রাজকীয় চালে হাঁটা লাগাল নিজের গন্তব্যের দিকে। চারদিকে মুগ্ধ ক্যামেরার ‘ক্লিক ক্লিক’ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

বৃষ্টি নামব নামব করছে। হাওয়া অফিস শাসিয়েছে যে আমাদের আফ্রিকা সফরের পুরোটা জুড়েই থাকবে বৃষ্টি বাদলের আধিক্য। আমরাও ফেরার পথ ধরলাম। কিছুটা এগিয়েই একটু দূরে আবার চোখে পড়ল কয়েকটা গাড়ির জটলা। আমরাও গিয়ে ভিড়লাম সেখানে। বেশ কিছুটা দূর থেকে হলেও ভালোভাবেই দেখা গেল একটা ছোট্ট মতন টিলার উপরে একটা মা চিতা আর তার ছোট্ট বাচ্চাদের খেলার দৃশ্য। বাচ্চাদুটো খুবই ছোট। এই সময় ওদের গায়ের লোম সাদা কালো রঙের থাকে, ছোপ ছোপ দাগগুলো ফোটে না। বাচ্চাদুটো অতি চঞ্চল। বার বার মায়ের পিঠে উঠে পড়ছে, এ ওকে ঠেলে নামিয়ে দিচ্ছে মায়ের পিঠ থেকে। ছবি তোলার মতো নৈকট্য আর আলো না থাকা সত্বেও মন ভরে গেল প্রকৃতির বুকে প্রকৃতির সন্তানদের স্বচ্ছন্দ জীবনের একটা ঝলক দেখে।

দিনের আলো মিলিয়ে এসেছে প্রায়। আমাদের ড্রাইভার জর্জ আমাদের নিয়ে গেল অদ্ভুত একটা জায়গায়। আশেপাশে আর কোনো গাড়ি ছিল না তখন। লালচে রঙের মাটির মধ্যে বড় বড় কয়েকটা পাথর যেন খাড়া হয়ে একটা আবডাল তৈরি করেছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা বড় বড় ঝোপ আর সেখানে গোটা সংসার নিয়ে আয়েশ করছে একটা সিংহ পরিবার। সাধারণত সিংহদের পরিবারে একটা সিংহ এবং বেশ কয়েকটা সিংহী থাকে। কিন্তু এই পরিবারটায় দেখলাম দুটো পূর্ণবয়স্ক সিংহ আর গোটা সাতেক তরুণী সিংহীকে। জর্জ বলল যে খুব সম্ভব ওই সিংহদুটো সমবয়স্ক দুটো ভাই। ওদের হারেমটা ওরা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। সিংহগুলো আমাদের খুব একটা পাত্তা দিল না। হাই তোলা, আড়মোড়া ভাঙা ছাড়া ওদের খুব একটা কিছু করার ইচ্ছে ওদের ছিল না। এত কাছ থেকে এতক্ষণ ধরে সিংহ পরিবার বা Pride of Lion দেখা সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার।

তিন

২১ শে অগাস্ট ২০১৯।

বেলুনভ্রমণ ও অন্যান্য

আজ ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে বেরোনোর প্রস্তুতি। আজ আফ্রিকার জঙ্গলের উপর দিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াব বেলুনে চেপে। দেখতে পাব মাসাইমারার অরণ্য সাম্রাজ্য। ঠিক সাড়ে চারটের সময় হোটেলে এসে হাজির বেলুন সাফারি কোম্পানির গাড়ি যা আমাদের নিয়ে গেল হোটেল মাডাতে। চা কফি হট চকলেট সাজানো আছে শীত ভাঙাবার জন্য। গা গরম করে নিয়ে বেলুন পয়েন্টের দিকে হাঁটা দিলাম কোম্পানি নিয়োজিত গাইডের তত্বাবধানে। প্রায় দেড় কিলোমিটার মতো হেঁটে পৌঁছলাম একটা বিরাট মাঠের ধারে। সেই মাঠের মধ্যে পর পর শোয়ানো আছে মস্ত মস্ত রং বেরঙের বেলুন। প্রথমে জেনারেটরের সাহায্যে দৈত্যাকার সব পাখা ঘুরিয়ে সেই জোরালো হাওয়ায় ফোলানো হয় বেলুনগুলোকে তারপর গ্যাসের আগুনে তৈরি হয় গরম হাওয়া। সেই হাওয়া বেলুনকে ঠেলে তোলে আকাশে। বেলুনের নীচে বাঁধা থাকে একটা খাঁচা। সেই খাঁচাই হল বেলুন যাত্রীদের উড়ন্ত চেয়ার বা উড়ন খটোলা যাতে করে বাস্তবায়িত হয় যাত্রীদের হাওয়া সফর।

বেলুনে উঠতে আমার যে বিপত্তি হল তা আর বলার কথা নয়। খাঁচাটা শোয়ানো থাকে মাটিতে এবং সওয়ারিদেরও ওই খাঁচার মধ্যে শুয়ে পড়তে হয়। বেলুন যখন গরম হাওয়ার চাপে উপরের দিকে উঠতে থাকে, তখন শোয়ানো খাঁচাও সিধে হয়ে ঝুলে থাকে বেলুনের নীচে আর তার মধ্যে শুয়ে থাকা মানুষজনও আপনাআপনি সোজা হয়ে বসে পড়ে। তারপর আকাশ থেকে বসে বা দাঁড়িয়ে দেখা যায় প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য। আমিও সকলের মতোই খাঁচার মধ্যে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমার যেন দম আটকে আসছে। হ্যাঁচর প্যাঁচোর করে কোনো মতে বেরিয়ে এলাম। মনে হল আমার দারা আর হল না আকাশ সফর, গোটা টাকাটাই লোকসান। কিন্তু বেলুন কোম্পানির লোকেরা বুঝলাম আমার মতো যাত্রী সামলাতে যথেষ্ট পারদর্শী। যেই বেলুনের ওড়ার মুখে ওর খাঁচাটা সোজা হল, অমনি হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হল আলাদিনের দৈত্যের মতো গোটা কতক মুশকো লোক। আমাকে মুহূর্তের মধ্যে মাটি থেকে তুলে বলতে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দিল খাঁচাটার মধ্যে। ব্যস ! কেল্লা ফতে ! বাকি সাতজন বেলুন যাত্রীর সঙ্গে আমিও উঠে পড়লাম আকাশে।

তারপর… সে এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা ! ভোরের আলো ফুটতে থাকা আকাশের বুকে হালকা হাওয়ায় ভেসে চলা। নীচে বিছিয়ে আছে মাসাইমারার সাভানা তৃণভূমি। আকাশ থেকে চোখে পড়ছে ইম্পালার ঝাঁক। বেলুনের গ্যাস বার্নারের শব্দে সচকিত হয়ে ছুট লাগাচ্ছে তারা। পুব আকাশে পেঁজা পেঁজা হালকা মেঘের মধ্য দিয়ে লাল টুকটুকে সূর্যোদয়। আমাদের অনুরোধে বেলুন চালক আর একটু নীচে নামালেন বেলুনটাকে। চালক শুধু ওইটুকুই পারেন। বেলুনকে উপর নীচ করা ছাড়া ওঁদের হাতে আর কিছুই থাকে না। হাওয়ার গতি এবং হাওয়ার দিশাই বেলুনকে নিয়ন্ত্রিত করে। ক্রমশ চড়তে থাকল উত্তেজনার পারদ। উপর থেকে চারদিকে নানা রকম জীবজন্তু চোখে পড়তে লাগল। মারানদীর উপনদী পালোক নদীর মধ্যে জলহস্তী মানে হিপোর ঝাঁক, নানা ধরনের অ্যান্টিলোপ, হায়েনা, শকুন এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর ভিডিওতে দেখা হাজারে হাজারে ওয়াইল্ড বিস্ট আর পালে পালে জেব্রা। একটা সময় মনে হচ্ছিল দিগন্তরেখাটা যেন নড়ছে ওয়াইল্ড বিস্ট আর জেব্রাদের পায়ে। এক ঘণ্টার সফর শেষে বেলুন গিয়ে নামল মারা নদীর কাছে। আবার কয়েকজন সমর্থ এবং দয়ালু যুবক আমাকে সযত্নে বেলুনের খাঁচার মধ্য থেকে বের করে নামিয়ে দিল মাটিতে।

সেখান থেকে গাড়ি করে ব্রেকফাস্ট পয়েন্ট।

চমৎকার শ্যাম্পেন সহ ধীরেসুস্থে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের দিকে রওনা হলাম ড্রাইভার জোনাথনের সঙ্গে। জোনাথন বলল যে ও কিছুটা জঙ্গল ঘুরিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেবে। একটু এগিয়েই দেখা মিলল এক জোড়া হায়েনার। দিনেরবেলা হায়েনার দেখা মেলে না বলেই ধারণা ছিল। কিন্তু কপাল ভালো হলে সবই সম্ভব হয়। দেখতে পেলাম এক জোড়া উটপাখিও। তারপর যা দেখলাম, তা দেখার জন্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর অ্যানিমাল প্ল্যানেটের ফটোগ্রাফাররা দিনের পর দিন ওঁত পেতে বসে থাকে। একদিকে মোটামুটি ঘন ঝোপঝাড় আর সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় এক জোড়া পূর্ণবয়স্ক সিংহ আর সিংহী। সিংহের হারেম কিন্তু ছিল না শুধু জঙ্গলের রাজা আর রানী। সিংহটা ধীরে ধীরে সিংহীর দিকে এগিয়ে এল রতিক্রিয়ার উদ্দেশ্যে। সবে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে, সিংহীটা একটা চাপা গর্জন করে ছিটকে সরে গেল আর… স্পষ্ট দেখলাম যে সে তার সামনের পায়ের থাবা দিয়ে সিংহটার মুখে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল। সিংহ তো আর মানুষ নয়। কাজেই সে তার জৈবিক চাহিদাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা করল না। চুপ করে দুঃখী মুখে বসে পড়ল একটু দূরে একটা ঝোপের পাশে আর সিংহীটা মস্ত বড় একটা হাই তুলে পাশ ফিরে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল।

আরো একটু এগিয়ে দেখি বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। সামনে একটা প্রমাণ সাইজের চিতা গুঁড়ি মেরে প্রস্তুত হচ্ছে শিকারের জন্য। চারপাশে এতগুলো গাড়ি দেখে ও প্রথমটা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল বোধহয় তারপর নিজেকে পুরোপুরি একাগ্র করে ছুট দিল একটা থমসন গ্যাজেলের ঝাঁকের দিকে। যেন একটা সাদা রঙের বিদ্যুৎ ছুটে গেল। গ্যাজেলের দলটার প্রাণপণ ছুট। কখন যে ও গ্যাজেলটাকে ধরল বুঝতেই পারলাম না। শুধু কয়েক মিনিট পর দেখতে পেলাম শিকার সমেত চিতাটাকে। তখনও গ্যাজেলটা মরে নি। চিতাটা তার শিকারটাকে কামড়ে ধরে ভীষণ রকম হাঁপাতে হাঁপাতে বসে রইল একটা ঝোপের মধ্যে। চিতারা যেমন খুব জোরে ছুটতে পারে, তেমনই খুব দ্রুত ক্লান্তও হয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ ধরে আমরা গাড়ি থেকে দেখলাম চিতাটাকে। তারপর যখন ও দম ফিরে পেল, তখন শিকারটাকে টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল ঝোপের মধ্যে।

আরো কিছুটা এগিয়ে দেখা পেলাম মাসাইমারার বিখ্যাত সেক্রেটারি বার্ডের। পাখিটা উড়তে পারে না ভালো করে। উটপাখি, এমু বা আমাদের ময়ূরের মতো। ওর কানের কাছে আছে এমন একগুচ্ছ পালক যা দেখলে মনে হয় যে ওর কানে একটা কলম গোঁজা রয়েছে। সে কারণেই ওর নাম সেক্রেটারি বার্ড।

অবশেষে দেখা মিলল বহু প্রতীক্ষিত আফ্রিকার হস্তীযূথের। আফ্রিকার হাতিরা ভারতীয় হাতিদের তুলনায় আকারে অনেকটাই বড়। বিরাট বিরাট কান হয় তাদের আর বিশাল বিশাল দাঁত। আমাদের দেশে শুধু পুরুষ হাতিদের বড় বড় দাঁত থাকে কিন্তু আফ্রিকায় পুরুষ এবং মেয়ে উভয় ধরনের হাতিরই থাকে দেখানোর মতো বিশাল বিশাল দাঁত। এই দাঁতের জন্য এক সময় হাজার হাজার হাতিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে।

হাতির এই দলটা খুব একটা বড় নয়। একটাই পূর্ণবয়স্ক দাঁতাল ছিল দলে আর সেটাই খুব সম্ভব দলনেত্রী। আর ছিল একটা একদম ছোট্ট বাচ্চা। মায়ের সঙ্গে কী খেলা তার !

সন্ধ্যাবেলায় বেরুলাম সন্ধ্যা সাফারির উদ্দেশ্যে। নজর কাড়ল লম্বা গলা জিরাফদের বিশাল একটা দল। আমরা জানি জিরাফ আর জেব্রা প্রাকৃতিক পরিবেশে শুধুমাত্র আফ্রিকাতেই পাওয়া যায়। এই জিরাফগুলো বিখ্যাত মাসাই জিরাফ। উচ্চতায় এরাই সবার চেয়ে বেশি। লম্বা লম্বা পা ফেলে এরা নানা দিক থেকে এসে জড়ো হচ্ছিল একটা জায়গায় কোনো মিটিং বা সমাবেশে আসা মানুষের মতো। সঙ্গে ছিল অনেকগুলো বাচ্চা আর তাদের মধ্যে একটা মায়ের দুধ খাচ্ছিল।

একটু এগিয়েই দেখতে পেলাম আফ্রিকার বিখ্যাত মার্শাল ঈগলকে। বিশাল আকৃতি এই পাখিটার ডানাগুলো কালো আর বুকের কাছটা ধবধবে সাদা। ঈগলটাকে দেখেই চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল আশেপাশে চরতে থাকা ল্যাপউইং পাখিগুলো। তারপর একটা রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য। ঈগলটা তাড়া করেছে একটা বড় সড় খরগোশকে। খরগোশটা প্রাণভয়ে ছুটছে আর আকাশ থেকে কালান্তক যমের মতো ওর উপর নেমে আসছে ধারালো নখ আর তীক্ষ্ণ ঠোঁটের মার্শাল ঈগল। আমরা যতক্ষণ ছিলাম ওখানে, খরগোশটা লুকিয়ে ছিল একটা ঝোপের মধ্যে। তারপর কী হল জানিনা।

এর পর দেখতে পেলাম ফাঁকা মতন একটা জায়গায় একদল সিংহকে। সিংহ একটাই বাকি সব সিংহী। কয়েকটা বাচ্চা এবং কিশোর বয়সের ছানাও ছিল দলটার মধ্যে। ওদের থেকে একটু দূরে ঘোরাফেরা করছিল বিশাল সিংওয়ালা দুটো বুনোমোষ। আমাদের মনে হচ্ছিল সিংহগুলো কি মোষদুটোকে আক্রমণ করবে ? কিন্তু ওরা তো মানুষ নয়, ওরা জন্তু… খিদে বা ভয় না পেলে ওরা কাউকে আক্রমণ করে না।

ফেরার মুখে বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। আলোও এল ক্ষীণ হয়ে। তাড়াতাড়ি ফেরার পালা। শুরু হবে পরবর্তী সফর।

চার

আবার আসিব ফিরে/ চাঁদের পাহাড়ে।

২২ শে অগাস্ট ২০১৯।

আজ আমাদের মাসাইমারা সফরের বা সাফারির শেষ দিন। আক্ষরিকভাবেই সাত সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম লাঞ্চবক্স সঙ্গে নিয়ে। জঙ্গলে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল নতুন এক জাতের হরিণ, হার্টবীস্ট। এরা দেখতে কিছুটা আমাদের দেশের নীলগাইয়ের মতো।

একটু এগিয়েই দূরে ঝোপের মধ্যে একটা সিংহীর মুখ দেখা গেল। এই দুদিনে আমাদের এতবার সিংহ দর্শন হয়েছে যে অত দূর থেকে সিংহী দেখা আমাদের মধ্যে প্রথমটা কোনো উত্তেজনা জাগাতে পারেনি। জর্জের অভিজ্ঞ চোখ কিন্তু সিংহীটার সঙ্গে দেখতে পেয়েছিল তিনটে সিংহেরবাচ্চা। সিংহশাবকের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা হয় না খুব একটা। কারণ ওরা যখন খুব ছোট থাকে তখন ওদের মায়েরা ওদের অনেক দূরে এবং গোপন ডেরায় লুকিয়ে রাখে। আমাদের চোখের সামনে একে একে রাজপুত্তুররা ঝোপের ভিতর থেকে বেরোলেন। অত্যন্ত চঞ্চল হাবভাব তাদের। মায়ের লেজ ধরে টানছে, গায়ের উপর ওঠার চেষ্টা করছে, মুখের কাছে মুখ নিয়ে যাচ্ছে যাতে মা একটু আদর করে চেটে দেয়। মা বার বার ছদ্ম বিরক্তিতে সরিয়ে দিচ্ছে তাদের কিন্তু তার সজাগ দৃষ্টি বাচ্চাদের প্রতি। বেশ কিছুক্ষণ রোদে ধোয়া তৃণভূমিতে দেখলাম ওদের খেলা তারপর এক সময় ওরা মায়ের পিছনে পিছনে ঢুকে গেল ঘাস জঙ্গলের ভিতরে।

ঝোপের মধ্যে বসে থাকা একটা চিতা দেখতে পেলাম। মাসাইমারার ১৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র কুড়িটা চিতা আছে। এ যাত্রায় তিনবার চিতা দেখতে পেলাম আমরা। ভাগ্য বলতে হবে! অনতিদূরেই একটা মৃত জন্তুর অর্ধভুক্ত শরীর নিয়ে এক দঙ্গল শকুন আর মারাবুদের ভোজসভা।

আমাদের হোটেলের বারান্দা থেকে দেখতে পাওয়া তারেক নদী আসলে মাসাইমারার বিখ্যাত মারানদীর একটা বড়সড় উপনদী। এই তারেক নদীর তীরে আমরা দেখতে পেলাম বিখ্যাত ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’ এর একটা ছোট্ট ঝলক বা রেপ্লিকা। দলে দলে ওয়াইল্ড বিস্ট পায়ে হেঁটে আসা তীর্থযাত্রীদের মতো আসছে লাইন করে। সংখ্যায় তারা অগণন। তারেক নদীও মারা নদীর মতোই কুমির অধ্যুষিত। তবে আমরা যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ কোনো ওয়াইল্ড বিস্ট কুমিরের শিকার হয় নি।

কিছু দূর গিয়ে দেখি জিরাফ দম্পতির রোম্যান্স। পুরুষ জিরাফটা বেশ নায়কোচিত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আর মেয়ে জিরাফটা তার পাশে বেশ পোজ দেওয়ার মতো করে এসে দাঁড়াচ্ছে নানা ভঙ্গীতে। আবার মাঝে মাঝে লম্বা গলাটাকে বাঁকিয়ে সঙ্গীর গলা জড়িয়ে ধরছে। কী সুন্দর যে লাগছিল দেখতে !

আমাদের শেষ গন্তব্য মারানদী। মারা নদীর বুকে পাথরের মতো শুয়ে আর বসে জলহস্তী বা হিপোর দল। হিপোদের চামড়ায় স্বেদগ্রন্থি থাকে না তাই দিনের বেলা বেশির ভাগ সময়টাই ওদের জলের মধ্যে গা ডুবিয়ে থাকতে হয় নইলে সূর্যের তাপে ওদের চামড়া ফেটে যাবে। হিপোরা তৃণভোজী হলেও যথেষ্ট আক্রমণাত্মক স্বভাবের। ওদের আক্রমণে প্রচুর মানুষ প্রাণ হারায় প্রতি বছর।

মারানদীর জলে এখানে ওখানে প্রচুর কুমিরও চোখে পড়ল। ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’-এর সময় প্রচুর পরিমাণে ওয়াইল্ড বিস্ট আর জেব্রা কুমিরের শিকার হয় আর এভাবেই রক্ষিত হয় প্রকৃতির ভারসাম্য। স্থলে জলে সর্বত্র জীবন মৃত্যুর পালাবদল ঘটেই চলেছে অহরহ আর আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখছেন আর নিয়ন্ত্রণ করছেন মহাকাল।

সফর শেষ। এবার ফেরার পালা। হয়ত নতুন কোনো সফরের উদ্দেশ্যে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *