travel-tunganath

সময়ের প্রহরী তুঙ্গনাথ…
সৌমেন জানা

গল্প করতে করতে আমরা এসে পৌঁছলাম চোপতায়। পাহাড়ি গ্রাম এই চোপতা। তুঙ্গনাথের গেটওয়ে। চোপতার উচ্চতা ২৯০০ মিটার। শান্ত নির্জন পাহাড়ি গ্রাম চোপতা। পর্যটক মহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য। চোপতা থেকে হিমালয়ের বরফে ঢাকা কেদারনাথ, চৌখাম্বা, ত্রিশূল, গৌরিশঙ্কর, গঙ্গোত্রী, সুমেরু প্রভৃতি শৃঙ্গগুলি দেখা যায়। আমরা তরুনজিকে বিদায় জানিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটা লাগালাম ওপরের দিকে। গন্তব্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিব মন্দির। তুঙ্গনাথ। ১২০৭৩ ফুট উচ্চতায় উত্তরাখন্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার এই মন্দির। তুঙ্গনাথ কিন্তু চারধামের (কেদারনাথ-বদ্রিনাথ আর গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী) অন্তর্গত নয়! চোপতা থেকে সাড়ে চার কিলোমিটারের হাঁটা পথ তুঙ্গনাথ।

চোপতা

বিশদে বলার আগে আপনাদের একটু ছোট্ট করে বলে নিই । আমরা চারজন বাঙালি মানে, আমি আমার স্ত্রী পিয়ালী আর ট্রেকার পৃথ্বীশ সেন ও তার স্ত্রী সুদীপ্তা সেন ভারতের উত্তরাখন্ড ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে একদিন আমরা চলেছি তুঙ্গনাথ দর্শনে।

সামনে কয়েকটা দোকানের পেছনে ঘোড়াদের আস্তানা। তুঙ্গনাথের পথ এখান থেকেই শুরু। আমাদের আগে চারজনের একটা দল হেঁটে যাচ্ছে। তারাও বাঙালি। ওদের মধ্য থেকে এক জিন্স পরিহিত স্মার্ট মহিলা সেলফি তুলতে তুলতে ঘোড়ায় উঠলেন। কিন্তু তারপরেই আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেলেন তিনি। তার পটলচেরা চোখ রাতারাতি গোল হয়ে গেল। মুখটা দেখলাম শুকিয়ে আমসি। ঘোড়া একটু একটু নড়ছে। মহিলাও একটু একটু শিউরে উঠছেন। “নামিয়ে দাও”, “আমি এই ভাবে যেতে পারব না”, “ওরে বাবা রে”, “ঘোড়া বড্ড নড় রাহা হ্যায়” এই সব টুকরো-টাকরা কথা কানে ভেসে এল। এদিকে ঘোড়ায় চড়িয়ে ঘোড়াওয়ালা, ঘোড়ার পাছায় একটা থাপ্পড় মেরে দিল। আর ঘোড়াটাও ওপরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কয়েক কদম চলবার পরে এল আতঙ্কের দ্বিতীয় লহর। সম্ভবত মহিলাটি দেখতে পেয়েছেন ঘোড়াওয়ালা পেছনে রয়ে গেছে। ঘোড়া নিজের মর্জিমতো এগিয়ে চলেছে। ব্যাস আর যায় কোথায়! এবার চেঁচামেচি শুরু। আসলে ঘোড়া নাকি নিজে নিজেই চলে যাবে, কাউকে নিয়ে যাবার দরকার হবে না। ঘোড়াওয়ালার কথা শুনে মহিলাটির শেষ ভরসাটুকুও চলে গেল যখন তিনি আবার আবিষ্কার করলেন যে সোজা সামনে যাবার বদলে, ঘোড়া কেমন যেন কোনাকুনি হয়ে খাড়াই রাস্তা ধরে ওপরে উঠছে। শুকিয়ে যাওয়া গলায় চিঁচিঁ করে অনুযোগ করেন “তুমহারা ঘোড়া কোনাকুনি কিঁউ যাতা হ্যায়? হামকো নামিয়ে দাও”। গম্ভীর গলায় ঘোড়াওয়ালা জবাব দেয় –”হিম্মত না হারে মা-জি”। ব্যাস, ঐটুকুই ভরসা। “মা” যখন বলছে, তখন নিশ্চয়ই তাকে ফেলে দেবে না ঘোড়া থেকে।

তুঙ্গনাথ থেকে দেখা মেঘের সমুদ্র

সূর্যদেব এরমধ্যেই মেঘের রাজ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছেন। অনন্ত আকাশকে গ্রাস করে প্রকৃতিদেবী যেন এক গভীর ধ্যানে বসেছেন। ঘন্টাখানেক হাঁটার পর চড়াই ভেঙে রডোডেনড্রনের জঙ্গল পার করে ওপরে উঠতেই অবাক বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে সবুজ মখমলের গালিচা পাতা। গাড়োয়ালের ভাষায় এর নাম বুগিয়াল। বাঁদিকে তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজি মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছে, আর পাহাড়ের গা বেয়ে বুগিয়াল ওপরে উঠে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। জায়গাটার নাম ভূজগলি বুগিয়াল। বুগিয়ালের দিকে মুখ করে বসলাম। ঠান্ডা হাওয়া আদর করে গেল চোখে-মুখে। বড় স্বস্তি পেলাম। প্রতিটা শ্বাসে টাটকা অক্সিজেনে ভরে গেল ফুসফুস। চোখে আরাম মাখিয়ে দেওয়া সবুজের প্রান্ত শেষ হতেই দূরে পাহাড়ের পরত। সেগুলোর মাথা সাদা। ধবধবে সাদা। ছোট ছোট পাকদন্ডী পাহাড়ের শরীর বেয়ে উঠেছে, নেমেছে শিরা-উপশিরার মতো। বুকের মধ্যিখানটা হাওয়ায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে ক্রমাগত। মনটা শরতের মেঘের মত হাল্কা ভাবে দুলকি চালে ভেসে যাচ্ছে। দিগন্তের পাহাড় পেরিয়ে নীল আকাশ। সেখানে মেঘেরা চরে বেড়াচ্ছে। যদি ওদের সাথে আমিও চলে যেতে পারতাম! নাঃ সে মনে হয় আর সম্ভব নয়। এরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখলাম পিয়ালীরা কাছাকাছি চলে এসেছে। উঠে দাঁড়ালাম।

একটু ধীরে চলো — বলে পিয়ালী আর সুদীপ্তাদি একসাথে হাঁটা শুরু করল। আস্তে আস্তে।

অচেনা এক জগত তার রূপের ডালি সাজিয়ে যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। অসম্ভব একটা ভাল লাগার আবেশ যেন গ্রাস করে নিল সমস্ত সত্ত্বাকে। পথশ্রমের ক্লান্তি অনুভব করার বোধশক্তিটাই তো তখন বিলীন হয়ে গেছে। এটা যে গাড়োয়াল! গাড়োয়াল হিমালয়! প্রায় ৮,৮০০ ফুট উচ্চতার চোপতাকে অনেকে উত্তরাখণ্ডের মিনি সুইৎজারল্যান্ড বলেন। কারণ, এই সবুজ বুগিয়াল। আর সাথে আছে ‘আল্পাইন মিডস’-এর মতো সৌন্দর্য অর্থাৎ আল্পসে না গিয়েও এখানে আল্পাইন সৌন্দর্য দেখে নেওয়া যায়। অনেকক্ষণ হাঁটার পর আমাদের প্রথম অভ্যর্থনা জানাল মাখনরঙা লোমে চোখ ঢাকা একটি কুকুর। একজন মেষপালকের পোষ্য। এনার ডিউটি হচ্ছে ভেড়ারপালকে বন্যজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। সামনেই মেষপালকের ঘর। সেখানে চা বিক্রি হচ্ছে। আমরাও একটু রেস্ট নেব বলে বসে পড়লাম। এখানে দিনে ক’জন চা পান করতে আসেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সামনে লাল রঙের তরল ভর্তি কতকগুলি বোতল রাখা আছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ওগুলি রডোডেনড্রন ফুলের রস। কথায় কথায় আলাপ হল। “আশপাশ মে কোই দিখ নেহি রাহা হ্যায়। আপলোগ ক্যায়সে ইতনে দিনো তক আকেলা রহতে হে?”

আমার প্রশ্ন শুনে হেসে উত্তর দিলেন — আদত হো গিয়া সাব।

অদ্ভুত জীবন এদের। শীতের বরফ গলতেই বেরিয়ে পড়েন গাঁও ছেড়ে। সাথে পাল পাল ভেড়া, ছাগল আর মোটকা সোটকা কুকুর। গ্রাম ছাড়িয়ে উঁচু পাহাড়ের গায়ে বুগিয়ালগুলোতে ডেরা বাঁধেন। কাঠ, পাথর দিয়ে তৈরি ছোট অস্থায়ী ঘর। ফেরেন সেই শীতের শুরুতে। ততদিনে ভেড়া, ছাগলের গায়ের লোম বেশ বড় বড় হয়ে যায়। ঘন ও মোটা। সেই ভেড়-বকরির ‘উন’ (লোম) সংগ্রহ করে তার থেকে উল বা পশম বানানো হয়। সেগুলো বিক্রি হবে শহরে। এই যাযাবর জীবনে বুগিয়ালে সারাটাদিন কাটে ভেড়া চড়িয়ে। মাঝে মাঝে এই দোকানদারি। দৈনন্দিন রুটিনের কোনও পরিবর্তন নেই। কোনও টিভি নেই, রেডিও নেই। আপনাকে যদি দিনের পর দিন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া এইরকম সঙ্গীহীন জীবন কাটাতে হতো, তাহলে কেমন লাগত? মনে হয় অস্বস্তি লাগত, দমবন্ধ মনে হত। একটা সময় পাগল পাগল লাগত। অথচ খোলামেলা জীবনে কতই-না বায়নাক্কা। বাসে উইন্ডো সিটটা পেলাম না, দোকানে লাল রংয়ের চুড়িদার পেলাম না, সোনার দাম বেড়ে যাচ্ছে; এসব নিয়ে কতই না অসন্তোষ আমাদের!

পৃথিবীতে গুটি কয়েক মানুষ রোজ বহু মানুষের সর্বনাশ করে চলেছেন। কারো মুখের রুটি কেড়ে নিচ্ছেন, নিষ্ঠুর মানসিকতায় শিশুর মুখ থেকে মাতৃদুগ্ধ কেড়ে নিচ্ছেন, চলার পথে বিছিয়ে দিচ্ছেন কাঁটা। রক্তমাখা হাত পকেটে পুরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। আবার বিপরীত নমুনাও আছে । কাউকে না খেয়ে থাকতে দেখলে সত্যি কারো কারো ঘুম হয় না। অপরিচিত কেউ কষ্ট পেলেও নিজের অজান্তেই কারো বুক কেঁদে ওঠে।

তুঙ্গনাথ মন্দির

এই যাযাবরদের জীবন দেখলে সভ্যতার সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, প্রেম-ভালবাসা, রাগ, বিষাদ, অভিমান সব অনুভূতিগুলিই কেমন যেন যুক্তিহীন লাগে। সত্যিই হিমালয় মানুষকে সংযমী হতে শেখায়। শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে শেখায়। বিজ্ঞানের অপচর্চা যেমন সোনা-গয়না-বিলাসিতায় মোড়া ঝিকিমিকি আধুনিক জীবনে আমাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে। প্রকৃতিকে করেছে দূর। কিন্তু হিমালয় টোলের পন্ডিতের মতো প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখতে শেখায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখায়।

এদিকে সুয্যিটার মান ভেঙেছে। ধীরে ধীরে হাঁটলেও শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের ফোঁটা নামছে। এখানকার সবচেয়ে বড় স্বস্তিটা হল অন্যান্য জায়গার মতো ভিড়ভাট্টা একেবারে নেই। টুরিস্ট খুব কম; হাতে গুনে বলা যায়। যারা উঠছে বা নামছে, তাদের অধিকাংশই স্থানীয় বাসিন্দা, আর বাকিদের মধ্যে বেশীরভাগই বাঙালি। যেহেতু চোপতা থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার, তাই এখানে এসে অধিকাংশ লোকই থাকেন না। পুজো দিয়ে সেদিনই নেমে যান। চোপতা, উখিমঠ, সারিগ্রাম, গোপেশ্বর আশপাশের বেশ কয়েক জায়গার বাসিন্দাদের কাছে তুঙ্গনাথ অনেকটা আমাদের দক্ষিণেশ্বরের মতো। পঞ্চবটীতে বসাও হল, আবার পুণ্যিও হল। আসলে রথ দেখা আর কলা বেচা দুইই হল। যেখানে চারধামে লাখ লাখ লোক সেখানে ‘আল্পাইন মিডস’-এর মধ্যে দিয়ে হেঁটে সবথেকে উঁচু কেদারে উঠে ‘অর্জুনের’ বানানো মন্দির দেখার লোক তুলনামূলকভাবে অনেক কম। রাস্তা দিয়ে দু-একটা খচ্চর মালপত্র নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। গলার ঘণ্টি টুংটাং শব্দ করতে করতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে জমাট নৈশব্দে।
সামনে দুজন মধ্য বয়স্ক লোককে ধীরেসুস্থে হেঁটে উঠতে দেখলাম। লোক দু’জন নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথাবার্তা বলছিলেন। আমাকে দেখে খুব একটা প্রসন্ন হয়েছেন বলে মনে হল না। দু-একটা ট্যাঁরা ব্যাঁকা প্রশ্ন করলেন। “কাঁহাসে আয়ে হো? খেলনে কুঁদনেকে উমর মে ইধার ক্যয়া ঘুমনেকে লিয়ে আয়ে হো ?” মনে হল যেন কেবিসির ক্যুইজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। হঠাৎ একজন বিজ্ঞ বৃদ্ধ সামান্য ফিরে, একটু ঝুঁকে হাতের লাঠিটা আমার দিকে করে বিদ্রূপাত্মক গলায় প্রশ্ন করলেন — তুমকো পঞ্চকেদারকে বারেমে মালুম হে?

আমি ছোট্ট করে তাদের পঞ্চকেদারের গল্পটা বললাম — পঞ্চকেদারগুলি হল কেদারনাথ, মদমহেশ্বর, কল্পেশ্বর, রুদ্রনাথ আর তুঙ্গনাথ। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পান্ডবরা যখন পাপের আগুনে পুড়ছেন তখন তারা ঠিক করেন যে ভ্রাতৃহত্যার পাপ মোচন করতে তারা শিবের পুজো করবেন। সেই ইচ্ছায় শিবের সন্ধানে তারা বারানসীতে গিয়ে হাজির হন। কিন্তু মহাদেব এই পাপীদের হাতে ধরা দিতে রাজি নন। তাই তিনি একটি ষাঁড়ের রূপ ধারণ করলেন আর হিমালয়ে পাড়ি দিলেন। উত্তরাখন্ডের গুপ্তকাশীতে এসে তিনি বুগিয়ালের কচি কচি ঘাস খেতে লাগলেন। এদিকে পান্ডবরাও তাকে নানা জায়গায় খুঁজতে খুঁজতে উত্তরাখন্ডে এসে হাজির হলেন আর এদিকে বাবা শিবও এ পাহাড় ও পাহাড়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। পিছনে পিছনে ধাওয়া করলেন পান্ডবরা। এখন যেখানে যেখানে পান্ডবরা ষাঁড় রূপী শিবকে ধরেও ধরতে পারেনি মানে কোথাও লেজ ধরেছে কোথাও শিঙ ধরেছে কোথাও বা ঠ্যাং ধরেছে কিন্তু শিব তবু পিছলে পিছলে পালিয়ে গিয়েছেন, সেই স্থানগুলিই পঞ্চকেদার নামে পরিচিত। তুঙ্গনাথকে তৃতীয় কেদার বলা হয়।

আমার উত্তর শুনে তাদের মনে হয় বোধোদয় হল যে বাঙালিরা ফুর্তি করতে আসে না, আসে হিমালয়কে অনুভব করতে। আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। আমাকে প্রাইজ থেকে বঞ্চিত করেই ওনারা সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

তুঙ্গনাথ মন্দির যাওয়ার পথে

বুগিয়ালের মাঝ দিয়ে খাড়া রাস্তা শুরু হয়ে গেল। বাঁপাশে বুগিয়াল আর ডানপাশে কুয়াশায় ঢাকা খাদ। বুগিয়ালের মাঝে মাঝে নেতিয়ে পড়ে আছে রডোডেনড্রনের আবছা নিস্তব্ধ বন। মাঝে মাঝে শিরশিরানি উতল হাওয়ায় সেগুলি বেঁকে যাচ্ছে। বাতাসের সেই শীতল ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছে। মনে হচ্ছিল মিশমিশে হাওয়ার মধ্যে যেন কত মানুষের কোরাস মিশে আছে। তারা সুর ধরেছে। কিন্তু সঙ্গে কোনও যন্ত্র-অনুষঙ্গ নেই। চারদিক রহস্যাবৃত। কখনও পরিষ্কার আকাশ আবার কখনও মুহূর্তের মধ্যেই ঢেকে যায় কুয়াশায়। তখন মনে হয় পুরো ভ্যালিটা আকাশে ভাসমান। প্রকৃতির এই রুক্ষ রূপ আত্মস্থ করা কঠিন। ‘ভয়ঙ্কর-সুন্দর’ শব্দটা বইয়ের পাতাতেই এতদিন পড়েছি, এবার চাক্ষুষ করলাম। উপলব্ধি হল মহাদেবের রুদ্র-রূপের মহিমা, ‘সত্যম-শিবম-সুন্দরম’-এর যে কোনও পুঁথিগত ব্যখ্যাই যেন এর কাছে অপূর্ণ। দেবভূমি হিমালয়, তপঃভূমি হিমালয় তাঁর স্বীয়-মহিমা নিজ-গুনে প্রকাশ না করলে সাধারণ মানবের সাধ্য কী তাকে অনুভব করে!!

একটা বাঁক পেরোতেই সামনে কতগুলো দোকান দেখতে পেলাম। তার মানে তুঙ্গনাথ এসে পৌঁছেছি। কয়েকটা দোকান বলতে একটা করে টেবিলে পূজার সামগ্রী নিয়ে সাজানো পসরা। দোকানগুলোরই লাগোয়া খাট-বালিশ-বিছানা-কম্বলসহ গোটা কয়েক ঘর রয়েছে। অর্থাৎ এগুলো দোকান কাম হোটেল। আমরা যথারীতি প্রথমে এসেই কালী-কমলি ধর্মশালার শরণাপন্ন হলাম। ধর্মশালার কেয়ারটেকার সুনীল।

আমাদেরকে নিয়ে গেল কালী-কমলি ধর্মশালার দোতলায়। সেখানে মোট চারটে ঘর। তার মধ্যে ১ ও ২ নম্বর ঘরদুটো আমাদের জন্য বরাদ্দ হল। দশ বাই দশ ফুটের কামরা। হাইট প্রায় সাত-আট ফিটের মতো। লম্বা মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে মাথায় ছাদ ঠেকে যাবে, কারণ ঢালু ছাদ। তবে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিছানায় দুটো করে কম্বল এবং লেপ রাখা। বাথরুমটাও মন্দ না। কিন্তু জানলার একটা কোনা ভাঙা। সেটা দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকছে। কনকনে ঠান্ডা। আর এত হাইটে সবকিছুই যেন জলে ভিজে ঠান্ডা। কতগুলো খবরের কাগজের টুকরো দিয়ে ভাঙা অংশটা জোড়া তালির মতো বোজালাম। খাতায় নাম এন্ট্রি করে ব্যাগগুলো ধর্মশালার ঘরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে একটু বসলাম। সামনেই সুনীলের দোকান কাম রেস্টুরেন্ট। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে দেওয়াল আর মাথার ওপর পলিথিন দেওয়া একটা খাবার জায়গা। সেই হোটেলের ভিতরে পাথরের ওপর কম্বল বিছিয়ে সুন্দর বসার জায়গা। সামনে কাঠের বেঞ্চ। উনুনের সামনে বসে আছে সুনীল। পাশে একটা ঝোলা। তাপ্তি মারা। কথায় কথায় জানতে পারলাম, বছরে যে ছ’মাস তুঙ্গনাথ খোলা থাকে তখন সুনীল এখানে থাকে। একার হাতে কালী-কমলি ধর্মশালা আর খাবার হোটেল সামলায়, প্রসাদের ডালি বিক্রি করে। শীতকালে মন্দির বন্ধ হয়ে গেলে সেও ফেরত যায় নীচে, তার গ্রামে। সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। কাঠের ফার্নিচার বানায়।

— তোমার এভাবে দিন গুজরান হয়?

উল উঠে যাওয়া, ময়লা সোয়েটার পরা সুনীল সুদীপ্তাদির দিকে তাকিয়ে বলল — চলে যাচ্ছে জীবন। ভালভাবে নয় তবুও ঈশ্বরের কৃপায় বেঁচে আছি।

পাশে রাখা ঝোলাটা থেকে একটা মশলার কৌটো বের করে, ন্যুডলসের ওপর ছড়িয়ে দিল। সেই ঝোলাটাকে দেখে মনে হল খুব রহস্যময়। মস্ত বড় ঝুলিটায় বুঝি তার সারা জীবনের গল্প জমা হয়ে আছে। সেই গল্পের ঝোলাটি কাঁধে নিয়ে যেন আজীবন দেশ থেকে দেশান্তরে বয়ে বেড়াচ্ছে ।

তুঙ্গনাথ মন্দির যাওয়ার পথে

সুনীলের রেস্টুরেন্টে গরম গরম ন্যুডলস খাচ্ছি এমন সময়ে দু’জন বিদেশির আগমন ঘটল। সম্ভবত দু’জনেই ইউরোপিয়ান। তারা সুনীলের কাছে ঘর খালি আছে কিনা জানতে চাইল। সুনীল তাদের ঘর দেখিয়ে ৭০০ টাকা করে ভাড়া বলল। বিদেশিরা ভাড়া শুনে খুশি হলেন না, তারা সুনীলকে ৭০০ টাকার বদলে ৬০০ টাকা অফার করলেন। সুনীল রাজি হল না। হিমালয়ের এই নিভৃত কোণে যেখানে মাথার ওপর ছাদ পাওয়াটাই অচিন্তনীয় ব্যাপার সেখানে এসেও এরা কটা টাকার জন্য দরাদরি করছেন। অথচ সুনীল ইচ্ছে করলেই খাতায় নাম এন্ট্রি না করেও ওদের থাকতে দিয়ে পুরো টাকাটা আত্মসাৎ করতে পারত। কিন্তু সে করল না। ইউরোপের ‘কোয়ালিটি অফ লাইফ’ এবং ‘লাইফস্টাইল’ দুটোই ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে। কিন্তু ‘ভ্যালু অফ লাইফ’-এর দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে বলে মনে হল।

ভর দুপুরবেলা। মাথার ওপরে সূর্যদেবও আছেন। কিন্তু এরাজ্যে মনে হয় তাঁর কোনও প্রভাব নেই। হাড়কাঁপুনি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মন্দিরের দিকে এগোলাম। এবড়ো খেবড়ো পাথরের টুকরো বসিয়ে রাস্তা বানানো। বেশ খাড়াই রাস্তা। তবে সিঁড়ির উৎপাত বিশেষ নেই। মন্দিরের দিকে তাকাতেই কেমন একটা ঝিম ধরে গেল আমার মাথায়। একেবারে যেন আকাশের গায়ে ঠেকানো। মন্দিরের ওপরে বসানো একটি পাথরের সিংহমূর্তি আকাশের দিকে চেয়ে গর্জনরত। তার মুখ থেকে যেন রাশি রাশি সাদা মেঘ নির্গত হচ্ছে। চারপাশে তাকালেই যেন ঢেউ তোলা সমুদ্রের মতো পাহাড়ের পর পাহাড়। একটি থেকে আরেকটি পাহাড়ের মাঝে সাদা তুলোর মতো আটকে আছে মেঘ। কিছুটা এগোলেই নীচে অতল খাদ। ঝুপসি ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে জমি ঢালুতে নেমে গিয়েছে। দু’পাশের পাহাড়গুলো নেমে এসে এই খাদের সৃষ্টি। তার মাঝখান দিয়ে সর্পিল গতিপথ।

মন্দিরের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকেই জুতো খোলার জায়গা। জুতো খোলার পর পাথরের মেঝেতে পা রাখতেই সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল। হৃৎপিন্ডে কয়েক চামচ বাড়তি রক্ত চলকে উঠল। চাতাল এতটাই ঠান্ডা যে কহতব্য নয়। মন্দিরের ডানপাশে কতগুলি ছোট ছোট মন্দির। সেগুলোর উচ্চতা বড় জোর তিন ফুট করে। ভেতরে খুব পুরনো মূর্তি। চোখ মুখ ক্ষয়ে যাওয়া একটা গনেশের মূর্তিও রয়েছে। মন্দিরের চারপাশটা ঘুরে এসে পিয়ালী জিজ্ঞেস করল — ত্রিযুগীনারায়ণ আর এই তুঙ্গনাথের মন্দির দেখতে প্রায় একইরকম কেন?

প্রশ্নটা আপাতদৃষ্টিতে সরল, সোজাসাপটা। কিন্তু উত্তরটা সোজা নয় ।
ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের ইতিহাস তার দীর্ঘকালিন সংস্কৃতি ও ধর্মব্যবস্থা থেকে সঞ্জাত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই স্থাপত্যরীতি দেশের প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য ও বহিরাগত সাংস্কৃতিক সংযোগের পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রয়োগের ফলে চূড়ান্ত আকার নেয়। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ভারতের মন্দিরগুলির গঠন কাঠামো বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নয় বরং অনেকটা একইরকম। অথচ মন্দিরগুলি যে কতদিনের পুরনো সে বিষয়ে আজও ধাঁধাঁ রয়ে গেছে। একবার ভাবুন তো বহু যুগ আগে যখন সারা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে এই মন্দিরগুলি তৈরি হচ্ছিল সেই বৈদিক পূর্ববর্তী যুগে তো কাগজ আবিষ্কার হয়নি, ফলে মন্দিরের আকার সম্বন্ধীয় কোনও বই ছিল না। তাহলে মন্দিরগুলির আকার, আয়তনে এত সাদৃশ্য হল কী করে? কোনও একজন দক্ষ পন্ডিত নির্মানশিল্পীর পক্ষে তো সারা ভারতীয় উপমহাদেশ ঘুরে এই নির্মাণ কৌশল জ্ঞান বিতরণ করা সম্ভব নয়। তাহলে? এসব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। বেদের সময়কাল থেকে শ্রুতির মাধ্যমে মনে রাখা হতো। আর এইভাবেই মন্দির নির্মাণ কৌশল ছড়িয়ে পড়ে। রাতারাতি একদিনে বা কয়েক বছরে সেটা সম্ভব হয়নি।

ভারতীয় মন্দির নির্মাণের বিভিন্ন শৈলী আছে। সমগ্র ভারতের মন্দির শিল্পকে তিন ধরণের স্থাপত্য শৈলীতে ভাগ করা যায়। এগুলি হল নাগর, বেসর এবং দ্রাবিড়। নাগর শিল্পশৈলী সাধারণত উত্তর ভারতে দেখা যায়। বেসর মধ্য ভারতে এবং দাক্ষিণাত্যের অনেকাংশে দেখা যায়। অপর দিকে দ্রাবিড়শৈলী দাক্ষিণাত্যে। কিন্তু প্রত্যেকটি শৈলীতে জ্যামিতিক আদর্শের সাথে ধার্মিক ধ্যান ধারণাও জড়িত। যেগুলির সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। (১৪*) স্টেলা ক্র্যামরিসচের মতে মন্দিরের প্রতীকতত্ত্ব ও গঠন ভঙ্গিমা বৈদিক ঐতিহ্যের মধ্যেই নিহিত আছে। বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে ‘নাগর’ শৈলীর মন্দিরের নকশা ও নির্মাণ পদ্ধতির বর্ণনা পাওয়া যায়। দেবভূমির অধিকাংশ প্রাচীন মন্দির এই নাগর শৈলীতে নির্মিত।

তুঙ্গনাথ মন্দিরের ওপরের পাথরের সিংহমূর্তি

তুঙ্গনাথের মন্দিরগাত্রের পাথরগুলো কেমন যেন কালো হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় সবুজ শ্যাওলা জমেছে। স্থানীয়রা বলেন, এই মন্দির বানিয়েছিলেন পান্ডবরা, যা সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে মন্দিরের জীর্ণোদ্ধার করেন আদি শঙ্করাচার্য। সেই হিসেবে মন্দিরটি চোদ্দশ বছরের পুরনো। যুগ যুগ ধরে কোনও বদল হয়নি এই মন্দিরের। সময় যেন থমকে আছে এখানে। বর্তমান, ভবিষ্যৎ যেন অতীতের প্রহেলিকায় বিলীন হয়ে গেছে।

ইতালিয়ান পদার্থবিদ কার্লো রোভেলি বলেছেন ‘টাইম হল ইল্যুশন’। হ্যাঁ, মায়া। আর তুঙ্গনাথ যেন সেই মায়াখেলার জাদুকর। সময়ের নিয়ন্ত্রক। পান্ডবদের কথা বাদ দিয়ে আদি শঙ্করাচার্যের সময়কাল থেকে ভাবলেও চোদ্দশ বছর আগে তিনি কীভাবে এসেছিলেন এখানে? অথচ আজকের দিনে সোয়েটার, জ্যাকেট গায়ে দিয়ে আমাদের এখানে আসতে আসতে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। আর গাড়োয়ালের যে যে জায়গার মন্দির তিনি উদ্ধার বা প্রতিষ্ঠা করেছেন সেগুলি তো আজও দুর্গম। এই মন্দিরগুলিতে বছরে মাত্র ৬ মাস পুজো হয়। বাকি ৬ মাস নীচে গ্রামে তাদের দ্বিতীয় আবাসে প্রতীকী পুজো করা হয়। ছোটবেলা থেকে গুটিকয়েক মানুষের সৌজন্যে ধর্মকে আমরা ব্যবসার মতো ব্যবহার হতে দেখেছি। এখানে সেই ধারণা কিন্তু ভেঙে যায়। সব মন্দিরই যে ব্যবসার কেন্দ্র হতে পারে না, সেটা গাড়োয়ালে এলে বোঝা যায়। ভারতীয় সনাতন ধর্ম মানুষকে ব্যবসা করতে শেখায়নি বরং মানুষই ধর্মকে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করেছে ক্রমে ক্রমে।

মন্দিরের ভেতরে ঢুকলাম। আলো-আবছায়াময় গর্ভগৃহ। শঙ্করাচার্যের ছবি রয়েছে। শিবলিঙ্গের সাথে কিছু মূর্তি রয়েছে। পুজোর শেষে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম তখন আকাশের মেঘ আরও ঘন হয়ে আমাদের দিকে নেমে আসছে। নীচে নেমে সুনীলের রেস্টুরেন্টে আসন গ্রহণ করলাম। মন্দিরে যাওয়ার আগে ওকে দুপুরের খাবার বানাতে বলে এসেছিলাম। সুনীল গরম গরম হাতে বানানো রুটি আর আলু-ক্যাপসিকামের তরকারি পরিবেশন করল। সামনেই কাঠের জ্বলন্ত উনুন থেকে পাঁপড় সেঁকে এনে দিল। পেট ভরে খেলাম। দোকানের বাইরেটা তখন অন্ধকার। ঠিক যেন সন্ধে নেমেছে। হাতঘড়ি বলছে সবে আড়াইটে বাজে। এক-দু ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে শুরু হল। হইহই করে তিনজন যুবক সুনীলের রেস্টুরেন্টে আশ্রয় নিল। বাঙালি টোন। আলাপ জমে গেল ঐ সিচ্যুয়েশনে। সুপ্রিয়, তন্ময় আর অভিষেক তিন হৃদয়াত্মা বন্ধু কলকাতা থেকে এখানে ঘুরতে এসেছে। খানিকটা দূরে আরেকটা হোটেলে ওরা উঠেছে। কলেজলাইফ পার করে পেশার জগতে প্রবেশ করলেও তারা কেউ একে অপরকে ভোলেনি। এই তুঙ্গনাথে পর্যটকদের বেশিরভাগই বাঙালি। এমনকি অনেক হোটেলের গায়ে বাংলাতে লেখা আছে ‘এখানে ভাত পাওয়া যায়’। ভেতো বাঙালির জন্য প্রলুব্ধকর আমন্ত্রণ।

সন্ধে যত এগিয়ে আসছে ঠান্ডা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। একসময় মনে হচ্ছিল সোয়েটার, গ্লাভসেও শীত বাঁধ মানছে না। সারা শরীরটা সুঁচ ফোটানো বাতাসে পাতা ঝরা গাছের মতোই হু হু করে কাঁপতে শুরু করল। দোকানের মধ্যে জ্বলতে থাকা উনুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে গা-হাত-পা সেঁকতে লাগলাম। মন্দিরের আরতি শুরু হবে ৬টায়। সেটা দেখে রাতের খাওয়া সেরে একেবারে ঘরে লেপের তলায় আশ্রয় নেব বলে মনস্থির করলাম। এখানে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা বলতে সোলার এনার্জি। আস্তে আস্তে সোলার ল্যাম্পের আলো জ্বলে উঠেছে।

আমরা জোর কদমে এগোলাম মন্দিরের দিকে। চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে এগিয়ে চলেছি। কষ্টকল্পনা নাকি হ্যালুসিনেশন, জানিনা! পাহাড়ের অনেকটা ওপরে উঠে এসেছি তাই অক্সিজেনের অভাবে ভুলভাল দেখতে শুরু করলাম না তো ! এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য যে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। আকাশে দু’চারটে তারা জ্বলছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ছায়াঘেরা শরীর মাঝে মাঝে তাদের আড়াল করছে। আবছায়ায় দু’চারটে লোক মন্দিরের দিকে চলেছে। ছোট ছোট দোকানগুলোয় মিটমিট করে আলো জ্বলছে। দূরে পাহাড়ের ঢালে জোনাকির মতো আলো জ্বলছে। কিন্তু এমন প্রকৃতিকে যে দু’চোখ ভরে দেখব তার উপায় নেই। হিমেল হাওয়া কানে ফিসফিসিয়ে বলে যাচ্ছে “জোরে পা চালাও”। একটু নড়েচড়ে হাঁটা শুরু করলাম।

এবার জুতো পরেই চত্বরের ঠিক বাইরে মন্দিরের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। ঠান্ডা এতই বেড়ে গেছিল, খালি পায়ে ওই প্রাচীন পাথরে দাঁড়ালে পায়ে ফ্রস্টবাইট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ওদিকে মন্দিরে আরতি শুরু হল। হরিদ্বারের গঙ্গার ধারে জাঁকজমকপূর্ণ আরতির কাছে তুঙ্গনাথের এই আরতি যেন নিরুচ্চার, শান্ত। এখানে শত সহস্র আলোর ঝলকানি নেই। ভক্তদের তুমুল কোলাহল নেই। আছে শুধু ভক্তিরসের প্রাবল্যে জারিত মন্ত্রোচ্চারণ। বাইরে নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি হচ্ছিল। জীবনে অনেকবার এই শব্দ শুনলেও তুঙ্গনাথের সূক্ষ্ম ঢং ঢং শব্দগুলো যেন অন্যরকম ছিল। দিকদিগন্তের পাহাড়ি উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ছিল সেই সাংকেতিক বার্তা। যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল একটা বড় ধাঁধাঁ। কী সেই ধাঁধাঁ? জানিনা। কিন্তু ইঙ্গিত বহনকারী সেই শব্দগুলো যেকোন নাস্তিককেও ক্ষণিকের তরে হলেও ভাবান্বিত করে।

তুঙ্গনাথের চারপাশ

পরেরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম, এবার ফিরতে হবে। পিয়ালীর আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি, একটি পাখি ডান পাশের বুগিয়ালে ঘুরে ঘুরে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।

এদিকে পিয়ালীর মুখের কথাটা শেষ হয়েছে কি হয়নি সে তড়াক করে ক্যামেরা নিয়ে সেদিকে ছুট দিল। “ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই …. “। কিন্তু আমার কথা কানে নিলে তো! একে তো জ্বরে দুর্বল শরীর তার ওপর আবার গত রাতের শিশির পড়ে পাথর পিচ্ছিল হয়ে আছে, যেকোন মুহূর্তে পা স্লিপ করতে পারে। পাশেই অতল খাদ। ভেবেই ভয়ে আমার হাত-পা হিম হয়ে গেল। ওদিকে ক্যামেরায় চোখ রেখে তিনি যত এগিয়ে যান সেই লাজুক পাখিও তত পিছিয়ে যায়। ছবি তোলার নেশা তখন পিয়ালীকে পেয়ে বসেছে। পাথরের উপর পা রেখে রেখে অনেকটা ঢালে নেমে গেল। আর কিছুটা দূরেই গভীর খাদ। আমি উপরে দাঁড়িয়ে তখন দু’চোখ বুজিয়ে হাপুস নয়নে মহাদেবকে স্মরণ করে যাচ্ছি। “হে প্রভু, রক্ষা কর.. “। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানি না। কিছুক্ষণ পরে তিনি এসে বললেন, “এই দেখো দু’টো ছবি। আর কয়েকটা তোলার আগেই তিনি ফুড়ুৎ”। ছবি দেখব কি? আমি তখন আমার আধমরা প্রাণপাখিটাকে শান্ত করতে ব্যস্ত। একবার ভাবলাম ওকে বকি। কিন্তু এই আবেগী পিয়ালীকেই তো আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। বকলে যদি তার ঐ আবেগভরা উচ্ছ্বলতা আবার খাদের আঁধারে হারিয়ে যায়! কোনও দরকার নেই কিছু বলার, ভেবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।

— কী পাখি বলতো এটা?

— উত্তরাখণ্ডের স্টেট বার্ড ‘ইম্পেয়ান মোনাল’। পাখিটির মাথার রং ময়ূরী নীল, গলা তামাটে থেকে লালচে, পিঠের রং নীলাভ বেগুনি। লেজের দিকে লালের ছোঁয়া লাগানো ঘোর লাগা নীল। আর পিছনের ডানার একটুখানি নীলে নীল। কতো অদ্ভুত শেডের নীল। যেন নীল ক্যানভাসে নীল রং দিয়ে ছবি আঁকা। মাথায় ছোট ঝুঁটিটা দেখো তুঙ্গনাথ মন্দিরের ঘন্টার মতো নাড়াতে নাড়াতে চলেছে। অবশ্য বাহারি দেখে তোমরা ভেব না যেন এটা স্ত্রী পাখি। আসলে পুরুষ। স্ত্রী মোনাল প্রধানতঃ ধূসর রঙের, এদের গলা সাদা পালকে ঢাকা। পালকের বর্ণময়তাই একে অসাধারণ করে তুলেছে।

তবে যাই বলো বাপু, নামটা বড্ড খটমট — সুদীপ্তাদি বলল।

আমি একটু হেসে বললাম — হিমালয়ান মোনাল, বা ইম্পেয়ান মোনাল (lophophorus impejanus)। এই নামটার সাথেও বাঙালির এক অদৃশ্য সুতোর টান আছে।

— কী রকম? কী রকম?

— ঔপনিবেশিক ভারতের প্রথম, প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পের (১৭৩২-১৮০৯) স্ত্রী, লেডি মেরি ইম্পের স্মরণে ইংরেজ পক্ষীবিদ জন ল্যাথাম এই নামকরণ করেছিলেন। লেডি মেরি ইম্পে ছিলেন পক্ষী প্রেমিক। কলকাতায় তাঁর বাংলোতে তিনি একটি ছোটখাটো পক্ষীরালয় গড়ে তুলেছিলেন। লেডি মেরি ইম্পে তখনকার শিল্পীদের দিয়ে একটি অ্যালবাম বানিয়েছিলেন যেখানে মাপসহ পূর্ণ আকারের অনেক পাখির ছবি আঁকা হয়েছিল। এই ‘এলিজা ইম্পে’-এর নামটা কি চেনা চেনা লাগছে?

পিয়ালীর মাথা চুলকানো দেখে বললাম — আচ্ছা শোন তাহলে, ১৭৭৫ সালে ঐ এলিজা ইম্পের আদেশেই কলকাতায় মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়, ব্রিটিশ আমলে মহারাজ নন্দকুমারই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ফাঁসির সাজা পেয়েছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে মহারাজা নন্দকুমারের বিরূদ্ধে আনা একটি জালিয়াতি মামলার বিচার করে বাংলার বিচার বিভাগের ইতিহাসে বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা নন্দকুমারের বিচারের রায়কে বিবেচনা করে একে একটি ‘বিচারিক হত্যা’ (Judicial Murder) বলে মত প্রকাশ করেছেন।

সবাই দেখি আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। পৃথ্বীদা বলল — তুমি পারো বটে! কোথায় তুঙ্গনাথের মোনাল আর কোথায় বাংলার ইতিহাসের এক দুষ্টু ইংরেজ বিচারপতির মিষ্টি মেম!

— চল চল। আর দেরি করা যাবে না।

সুদীপ্তাদির ডাকে পিয়ালী সামনের দিকে এগোতে লাগল ধীরে ধীরে। নামার সময় মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছিলাম। অদ্ভুত ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন দেহ। তবে মনের অতলস্পর্শী তলে কোথাও একটা প্রচ্ছন্ন হর্ষোল্লাস কল্লোলিত হচ্ছে। জীবনের ভাল লাগা, ভালবাসার কিছু মুহূর্ত রেখে যাচ্ছি এখানে। তুঙ্গনাথের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে রইল সেই সুখানুভূতি। আমি থাকি বা না-থাকি অনন্তকাল ধরে তুঙ্গনাথের দুর্ভেদ্য ছায়া, নিবিড় তিমিরতলে বিজন তারার মাঝে ঘন ঘন কম্পিত হবে। দীর্ঘরাতের যাপন শেষে ধরা সিক্ত হবে শিশিরকণায়। লুটিয়ে পড়বে ঘাসের ডগায়। হে সখা আমি ফিরে আসব আবার তোমার কাছে। চাঁদনী পশর রাতে টলমল পায়ে। জ্যোৎস্নাস্নাত তুষারচুড়ার পানে চেয়ে চেয়ে বিনিদ্র রাত্রিযাপন করব দু’জনে। ফিরে আসব তোমার মায়াময় নির্জনতার মাদকতায় নেশাতুর হতে। আপাতত বিদায়। হে প্রিয়সখা, বিদায়!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *